দরকার নারী-পুরুষে সমতা
১৭ জানুয়ারি ২০১৭ইন্টারনেটে ভালো-মন্দ, সত্য-অসত্য নানা কিছু পাওয়া যায় – তথ্য, আপনার পছন্দের সংগীত, এমনকি সেক্সও৷ যাবে না কেন? কথায় তো আছে – ‘সেক্স সেলস'৷ কিন্তু বাজারে বিক্রি হয় বলেই কি আমাদের সেটা কিনতে হবে? আমাদের কি নিজস্ব রুচি বলতে কিছু নেই? নেই আত্মমর্যাদা, নারীর প্রতি সম্মান?
এ প্রশ্ন আমার আজকের নয়৷ মনে পড়ে, তখন কলেজে পড়ি৷ আমার প্রথম বসন্ত, প্রথম প্রেমের সময়৷ তখন একদিন না জানিয়েই চলে গিয়েছিলাম সেই বিশেষ বন্ধুর বাড়িতে৷ গিয়ে দেখি, সে একটা ‘ব্লু-ফিল্ম' দেখছে৷ বললাম, ‘‘আমিও দেখবো৷'' কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো, গুলিয়ে উঠলো গা৷ এ কী দেখছি! এ তো নারী-পুরুষের ভালোবাসা নয়, এ তো ক্ষমতার চরম প্রদর্শন৷ সেক্সের নামে মেয়েদের যন্ত্রণা দেওয়া, অকথ্য নির্যাতন, অমর্যাদা...!
আমার পুরুষ বন্ধুটি অবশ্য সে কথা মানতে চায়নি৷ তাকে ভালোবাসার দোহাই দিয়েও আমার মনন-যন্ত্রণার কথা বোঝাতে পারিনি সেদিন৷ আর সে মানবেই বা কেন? সে-ও তো পুরুষ৷ আর এই পুরুষরাই তো পর্নো ছবির প্রধান দর্শক৷ পুরুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই তো এসব তৈরি হয়, বিক্রি হয়৷ মেয়েদের দাসীবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, পর্নোবৃত্তি সবই যে পুরুষের ভোগের জন্য৷ আচ্ছা, আপনিই বলুন, আপনার দেখা কোনো পর্নো ছবিতে কি নারীর স্বাভাবিক যৌনাকাঙ্খার মূল্য দেওয়া হয়েছে? হয়নি৷
পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন অবশ্য নতুন নয়৷ সত্তরের দশক থেকেই পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন পশ্চিমের নারীবাদীরা৷ এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথরিন ম্যাককিনন৷ তবে তিনি এটা বলেননি যে, পর্নোগ্রাফি অশ্লীল, তাই একে নিষিদ্ধ করো৷ বরং তাঁর কথায়, পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করতে হবে, কারণ, ‘সেক্স ডিসক্রিমিনেশন' বা লিঙ্গ বৈষম্যই শুধু নয়, এর মাধ্যমে নারীর অধিকারও লঙ্ঘিত হয়৷ কিন্তু সেই আন্দোলনে কাজ হয়নি৷ যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় জায়গায় নারীবিরোধী পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করার লড়াই তাঁকে আজও করে যেতে হচ্ছে৷
তাঁর মতো নারীবাদীরা বলেন, পর্নো ছবিতে সাধারণত যে যৌনতা দেখানো হয়, তা নিতান্তই পুরুষের দাপট দেখানোর নামান্তর৷ অর্থাৎ পুরুষরা মারবে, মেয়েরা মার খাবে৷ পুরুষরা যথেচ্ছাচার করবে, মেয়েটিকে বেঁধে, চাবকে, চড়িয়ে, উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করবে, কিন্তু মেয়েটি মেনে নেবে৷ তাদের মান, সম্মান, অধিকার, স্বাধীনতাকে যত খর্ব করা হবে, ততই আনন্দ পেতে হবে তাদের, হাসতে হবে খিলখিল করে৷ অবশ্য এমনটা আমার-আপনার দেখা বহু মেয়েকেই রোজই করে যেতে হয়৷ ‘বর' নামের প্রভুটির কথায় উঠতে-বসতে হয় নিত্যদিন৷ এমনকি স্বামীর ছলনায় ভুলে নিজেরাই অনেকসময় পর্নোস্টার হয়ে ওঠেন তারা, নিজেরই অজান্তে৷
‘পর্নোগ্রাফি' শব্দটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘পর্ন' ও ‘গ্রাফোস' থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ – বারাঙ্গণাদের সম্পর্কে লেখালেখি৷ পর্ন শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘বেশ্যা'৷ আরো পরিষ্কারভাবে বললে, সবচেয়ে নীচু জাতের ‘গণিকা' বা যৌনকর্মী৷ সুতরাং পর্নোগ্রাফির মানে কোনোভাবেই ‘যৌনকর্মের বিবরণ' অথবা ‘কামোদ্দীপক বর্ণনা' নয়৷ পর্নোগ্রাফির অর্থ – জঘণ্য, সস্তা, ‘বেশ্যা' রূপে নারীর চিত্রায়ন৷ আমি নারীর এমন চিত্রায়নের বিরোধী৷ বিরোধী নারীকে যৌন সম্ভোগের সামগ্রী হিসেবে, বেশ্যা হিসেবে দেখানোর৷ সে কারণেই আমি পর্নোগ্রাফির বিরোধী৷ অথচ দেখুন, আমাদের সংস্কৃতিতে, মহাকাব্যগুলোতেও কিন্তু এমন অসংখ্য নারী চরিত্র আমরা পেয়েছি৷ কামসূত্রের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু খাজুরাহো অথবা কোনার্কের সূর্য মন্দির? সেখানকার শিল্প-স্থাপত্যে যৌনতা, কাম, সম্ভোগ – এই বিষয়গুলি কি আসেনি?
আবার ধরুন, মানুষ কে সৃষ্টি করেছে? ঈশ্বর৷ তা ঈশ্বর কে? হ্যাঁ, একজন পুরুষ৷ অর্থাৎ, পুরুষের যৌন আধিপত্যের বাস্তব কাঠামোর মধ্যেই একজন ‘বেশ্যা' টিকে থাকে৷ ঐ কাঠামোয় একজন নারী শুধুমাত্র যৌনবস্তু, তার অন্য কোনো সত্তা নেই৷ তাই পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহৃত নারীর যৌনতারও একইভাবে মূল্যায়ন হয়৷ তাদের আলাদা কোনো জীবন নেই, সুখ-দুঃখের কথা তো ছেড়েই দিলাম৷ শুধু তাই নয়, পর্নোগ্রাফিতে পুরুষ যেভাবে নারীর ওপর বলপ্রয়োগ করে, সেটাও কি বাস্তব নয়? আমি তো বলবো, একেবারে বাস্তব, বস্তুনিষ্ঠ৷ কারণ, আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও যে এ রকম বলপ্রয়োগ নারীর বিরুদ্ধে হচ্ছে প্রতিনিয়ত৷ হচ্ছে না? ঘটছে না ধর্ষণ, দাম্পত্য ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, নির্যাতন অথবা হত্যার ঘটনা?
অন্যদিকে নারীর যৌন-স্বাধীনতাতেও বিশ্বাসী আমি৷ মানে কেউ যদি স্বেচ্ছায় পতিতাবৃত্তি বা পর্নো ছবি করে, তবে তাকে বাধা দেওয়ার আমি কে? কিন্তু যৌন-স্বাধীনতার নামে যৌন-পরাধীনতা বা পতিতাবৃত্তির পক্ষ আমি একজন নারী হয়ে কীভাবে নেব? বিশেষ করে এটা জেনে, এটা বুঝে যে, আমাদের সমাজে, এই বিশ্বে, নিজের ইচ্ছায় ক'টা মেয়ে এমন কাজ বেছে নেবে? তাই পর্নোবিরোধী নারীবাদীদের মতোই আমি যৌনতা বা ‘ইরোটিসিজম'-এর বিরুদ্ধে নই৷ বরং আমি ‘ভায়োলেন্স' বা সহিংসতাকে ‘ইরোটিসাইজ' করার বিরুদ্ধে৷ হিউমিলিয়েশন, অসম্মান, অপমানকে, যন্ত্রণাকে ‘ইরোটিসাইজ' করার বিরুদ্ধে৷
তাই পর্নোগ্রাফি নিয়ে আলোচনা করার আগে, তার ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরার আগে, প্রয়োজন নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা, সম অধিকার আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক৷ কারণ, যতদিন না নারী শিক্ষিত ও স্বনির্ভর হচ্ছে, যতদিন না নারীবিরোধী কুসংস্কারের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হচ্ছে, যতদিন না সম অধিকার পাচ্ছে নারী, ততদিন নারীর শরীর নিয়ে পুরুষের বিকৃত উৎসব চলতেই থাকবে, থাকবেই৷
দেবারতি গুহকে বা তাঁর লেখা নিয়ে আপনি কিছু বলতে চান? তাহলে লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷