বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা
১০ মে ২০১৭মূলত গাড়ির গতিই যেন টলিউডের যাবতীয় পথদুর্ঘটনার নেপথ্যে, দু-বছরে তারকা মহলের পাঁচটি দুর্ঘটনা তার প্রমাণ৷ অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে হেলমেট ছাড়া বাইক চালিয়ে আরোহী নিজের মৃত্যু ডেকে আনছেন৷ বুদ্ধিজীবী মহলেও কথা উঠছে, পথ দুর্ঘটনা এড়ানোর দায়টা শুধু সরকারের নয়, নাগরিকেরও৷ তাই পথে নেমে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে৷ পাশাপাশি বিশিষ্টজনদের রাত্রিকালীন জীবনযাপনের অভ্যেসেও পরিবর্তন দরকার৷
কলকাতা শহরে গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ২৪৬টি পথ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের এ হিসেব চমকে দেওয়ার মতো৷ ২০১৫ সালে রোজ সারা দেশে গড়ে ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, ২০১৬-য় সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয় ৪১০৷ গত বছরে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দেড় লক্ষ৷ ছয়টি রাজ্যে দুর্ঘটনার প্রবণতা বেশি৷ সেই তালিকায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে৷
কলকাতা শহরের যে কোনও বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালে, বিশেষত বেশি রাতের দিকে, হেলমেটহীন আরোহীর দ্রুত গতির ছুটন্ত বাইক নজরে পড়বে৷ হেলমেট ছাড়া বাইক চালানোতেই যেন নায়কোচিত রোমাঞ্চ! অথচ জনতাকে সচেতন করতে ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ' কর্মসূচিতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা৷
ট্রাফিক পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম৷ শুধু পুলিশি নজরদারি নয়, শহরে ১,৬০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে৷ কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ৮৫০টি মোড় রয়েছে ক্যামেরার নজরদারিতে৷ শ্যামবাজার, উল্টোডাঙা বা গড়িয়াহাটের মতো যেসব মোড়ে গাড়ির চলাচল বেশি, এমন ৩৫০টি স্থানে একাধিক সিসিটিভি বসানো হয়েছে৷ গাড়ির গতি নির্ধারণ করতে বিভিন্ন রাস্তা ও উড়ালপুলে বসেছে স্পিডমিটারসহ ক্যামেরা৷ পাশ দিয়ে গেলেই সেই বোর্ডে ফুটে উঠছে, গাড়ি কত গতিতে চলছে৷ ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ' অভিযানে গাড়িতে স্পিড গভর্নর লাগানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ হেলমেট ছাড়া মোটরবাইকের তেল দেওয়া হচ্ছে না৷ পুলিশি নজরদারি ও সিসিটিভি তো রয়েইছে৷ তবুও দেখা গিয়েছে, শহরের ৩২ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে হেলমেট না থাকার জন্য ও ৭ শতাংশ সিটবেল্ট না পরার জন্য৷ এর সঙ্গে নিয়মিত চলছে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার৷ তবুও ঠেকানো যাচ্ছে না পথদুর্ঘটনা৷
গত ৭ মার্চ জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী ও গানের দল ‘দোহার'-এর প্রাণপুরুষ কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে গাড়ির গতি, চালকের দায়িত্ব বা তাঁর লাইসেন্সের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল৷ সম্প্রতি পথদুর্ঘটনায় আহত ও অভিযুক্ত টলিউড অভিনেতা বিক্রম চট্টোপাধ্যায়ের বেপরোয়া গতি ফের সেই প্রশ্নটাই তুলেছে– ‘‘আমরা আর কবে সচেতন হব?''
গত ২৯ এপ্রিল ভোরে রাসবিহারী মোড়ের কাছে বিক্রমের গাড়ি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে৷ চালকের সিটে ছিলেন তিনি নিজেই৷ ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির গতি ছিল ১২০ কিলোমিটার৷ গতির জন্যই রাস্তার ধারের ডিভাইডারে ধাক্কা খেয়ে গাড়ি উল্টে যায়৷ মারা যান বিক্রমের সহযাত্রী, নামী মডেল সনিকা চৌহান৷
এখানেই শেষ নয়৷ এর আগে ২৩ এপ্রিল এমনই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন বাংলা ছবির জনপ্রিয় অভিনেতা হিরণ৷ হাওড়ায় বাসের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল তাঁর গাড়ি৷ প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের কয়েক জায়গায় চোট পেয়েছেন তিনি৷
২০১৫ সালের ২০ অক্টোবরের ঘটনাও ভোলার নয়৷ হাওড়ার সাঁতরাগাছি সেতুর কাছে টলিউডের আরেক অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে৷ বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মারাত্মক জখম হয়ে পাঁচদিন পর প্রাণ হারান তিনি৷
কিছুদিন আগে কুচকাওয়াজের মহড়াতে অডি গাড়ির গতির শিকার হয়েছেন সেনাবাহিনির এক জওয়ান৷ উড়ালপুলে বাইকের রেসে প্রাণ হারিয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী৷ গত মার্চেই অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাতি অভিনেতা রণদীপ বসুর বাইক ডিভাইডারে ধাক্কা মারে৷ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে প্রাণে বাঁচলেও তিনি এখনও হাসপাতালে৷
সেলেব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ– এত মৃত্যু সত্ত্বেও টনক নড়ছে না কেন? বিশিষ্ট মনোবিদ কামাল হোসেন বলেন, ‘‘ভুবনায়নের ফলে আমাদের মানসিক গঠন বদলে যাচ্ছে৷ ছেলেরা ইএমআই দিলেই বাইক চাপতে পারে৷ বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও সিনেমার কসরত দেখে তারা গতির নেশায় বুঁদ৷ সঙ্গে বান্ধবী থাকলে কথাই নেই৷ নায়ক হওয়ার রোমাঞ্চে তারা নিজের জীবনের কথা মনে রাখছে না৷''
তবে শুধু কমবয়সি ছেলেরা নয়, অনেক মাঝবয়সি ব্যক্তিকেও দেখা যায়, হেলমেট ছাড়া সপরিবার বাইক সফর করছেন, অথবা চারচাকায় বসছেন সিটবেল্ট ছাড়া৷ এই প্রবণতা কেন? ডা. হোসেনের মতে, ‘‘এটা এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের ফল৷ কিছুটা অবহেলাও বটে৷ না হলে নিজের সন্তানকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে আসার সময় বাবা তাকে হেলমেট পরাবেন না কেন?''
শুধু সচেতনতা নয়, দুর্ঘটনার পিছনে পরিকাঠামোর অভাবের ভূমিকাও রয়েছে৷ রোড মার্কিং, রাস্তার ডিভাইডার বা ট্রাফিক সাইনেজ পর্যাপ্ত নয়৷ এমনকি জেব্রা ক্রসিংয়ের অভাব বা ফুটপাত বেদখলও সমস্যা সৃষ্টি করে৷ গাড়ির রেষারেষি বা ওভারটেক করার প্রবণতাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ৷ গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি বা চালকের শারীরিক অক্ষমতাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ৷ দুর্নীতির অভিযোগও তুলছেন অনেকে, যে কারণে অপরিপক্ব চালকেরা লাইসেন্স পেয়ে রাস্তায় গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা ঘটছে৷
এ বছরের ৭ মার্চ সিউড়ি যাওয়ার পথে হুগলির গুড়াপের কাছে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী কালিকাপ্রসাদ৷ গাড়ির চালক আগের দিন রাত জেগেছিলেন বলে অনুমান৷ তাঁর ক্লান্তিজনিত অবসন্নতাও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে৷ সেই ঘটনার সাক্ষী দোহার-এর সদস্য, কণ্ঠশিল্পী রাজীব দাসের উপলব্ধি, ‘‘নিজেদের সচেতন হতে হবে৷ প্রাণের মূল্য বুঝতে হবে৷ সরকার যতই প্রচার করুক, আমরা না ভাবলে পরিস্থিতি পাল্টাবে না৷'' তিনি জানান, একজন ছাড়া দলের বাকি সদস্য অনুষ্ঠান করার মতো অবস্থায় রয়েছে, যদিও কেউই পুরোপুরি সুস্থ নন৷
তবুও দুর্ঘটনা রুখতে সচেতনতা বাড়ানোর মতো প্রচার যে চালাতেই হবে এ বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই৷ সমাজের অগ্রণী অংশ, চলচ্চিত্র শিল্পীদের মতো গণমাধ্যমকেও সজাগ হতে হবে৷ তামাক বা মাদকের ক্ষেত্রে যেমন বিধিসম্মত সতর্কীকরণ করার দায়িত্ব বর্তায়, ঠিক তেমনি হেলমেটহীন বাইক চালানোর ক্ষেত্রেও দায়িত্বজ্ঞান দেখানোর গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে৷
সম্প্রতি বিরসা দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘ওয়ান' ছবিতে নায়ককে বাইকে হেলমেট ছাড়া দেখা যাওয়ায় উঠেছে এ প্রশ্ন৷ কেন্দ্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন এক শিক্ষক৷ চলচ্চিত্রের পর্দায় যাঁদের দেখা যায়, তাঁরা যদি নেশা করে গাড়ি ছোটান, তাহলে তাঁদের যাঁরা অনুসরণ করেন, সেই মানুষদের কাছে কী বার্তা যাবে?
দুর্ঘটনায় লাগাম টানতে আইন আরও কড়া হচ্ছে৷ ১৯৮৮ সালের মোটর ভেহিকল অ্যাক্টে একগুচ্ছ সংশোধনী আনার পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্রও৷ ট্রিপল রাইডিং বা বাইকে তিনজন সওয়ারি, ট্রাফিক সিগন্যাল ভাঙা বা হেলমেট ছাড়া বাইক চালানোর ক্ষেত্রে জরিমানা বাড়িয়ে ১০০ থেকে ১০০০ করা হয়েছে৷ জরিমানার এই অঙ্ক কত গুণ করা হবে, বিভিন্ন রাজ্য ইচ্ছে করলে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷