বোমায় দগ্ধ জীবন
৩০ জানুয়ারি ২০১৫
৬ই জানুয়ারি থেকে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের অবরোধ আর হরতালে পেট্রোল বোমার ব্যবহার বেড়ে গেছে বাংলাদেশ৷ সরকারের পক্ষ থেকেও এহেন ঘটনা প্রতিরোধে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷ আর তাতেই সৃষ্টি হয়েছে এ পরিস্থিতি৷ কিন্তু এত সহিংসতার পরও রবিবার থেকে আবার ৭২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি৷
ঢাকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে এখনো যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সালাহউদ্দিন(৩৭)৷ ২৩শে জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসে পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণের পলে তাঁর শরীরের ৪৭ শতাংশ পুড়ে গেছে৷ তাঁকে দেখলে মনে হয় যেন এক জীবন্ত মমি৷ সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাধা৷ ছোট ছোট দুই সন্তান হাসিব ও আবির বাবার এই অবস্থায় হতবাক৷ তাদের কথা, ‘‘বাবার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কী হবে?''
সালাহউদ্দিনের স্ত্রী উর্মি আক্তার বলেন, ‘‘আমার স্বামী রাজধানীর একটি শপিংমলে কাজ করেন৷ ২৩শে জানুয়ারি পেট্রোল বোমায় আহত হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসি৷ দু'সন্তানকে তাদের বাবার পোড়া শরীর যাতে না দেখতে হয়, সেজন্য বাসায় তাঁদের বলতে গেলে আটকে রাখতে হয়েছিল৷ কিন্তু তারপরও ঠেকানো যায়নি৷ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে বাবাকে দেখাতে তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে হয় শেষ পর্যন্ত৷ কিন্তু বাবাকে দেখার পর প্রথমে কান্না এবং পরে অনেকটা নির্বাকই হয়ে গেছে তারা৷''
ট্রাকের হেলপার জাহাঙ্গীরের (৩০ ) ৫৩ শতাংশ শরীর পুড়ে গেছে৷ তাঁর স্ত্রী বিউটি জানান, ‘‘২৩শে জানুয়ারি বগুড়া শহরের চারমাথা মোড়ে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন জাহাঙ্গীর৷ এখনো আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে তাঁকে৷ ডাক্তার বলেছেন, তাঁর অবস্থা বেশ খারাপ৷''
বিউটির কথায়, দুটি শিশু সন্তান জাহিদ ও জুঁই আক্তারকে নিয়েই তাঁদের সংসার৷ মাথার ওপর দেনার পাহাড় জমছে৷ জাহাঙ্গীরকে বাঁচানো না গেলে দু'সন্তান নিয়ে ভিক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না৷ ‘‘ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন যে এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে৷''
দগ্ধ রোগীদের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে বার্ন ইউনিটের বাতাস৷ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে স্বজনদের কান্না৷ এরপরও প্রতিদিনই নতুন কোনো ঝলসানো মানুষ আসছেন হাসপাতালে৷ নতুন শোকার্ত স্বজন৷ বেড নেই৷ ঠাঁই নেই৷ কিন্তু বোমার জোগান শেষ হয় না৷ এভাবেই দিন যাচ্ছে আর বার্ন ইউনিটে ফিকে হয়ে আসছে অনেকের স্বপ্ন, মানুষের মতো বেঁচে থাকার আশা৷
চিকিত্সকরা চিকিত্সা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন৷ তাঁদের কাছে এখন আর রাত দিন নেই, নেই ‘ডিউটি আওয়ার'৷ তাঁরা সবাই মানবতার সেবায় এ সব ভুলে গেছেন৷ বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক ডা. মো. সাজ্জাদ খোন্দকার জানান, পেট্রোল বোমায় আহতসহ সাড়ে পাঁচশ' রোগীর চিকিত্সা করে যাচ্ছেন তাঁরা৷ রোগীদের যথাযথ চিকিত্সা সেবা দেয়ার জন্য আরও ডাক্তার ও নার্স সংযুক্ত করা হচ্ছে৷
তিনি জানান, ‘‘পেট্রোল বোমায় আহত রোগীদের চিকিত্সা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া৷ ধীরে ধীরে এ সব রোগীকে সুস্থ জীবনের দিকে নিয়ে যেতে হয়৷'' পেট্রোল বোমায় দগ্ধ আটজনের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘রোগীদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও আমরা দিন-রাত চিকিত্সা দিয়ে যাচ্ছি৷ কিন্তু এখানে বেড আছে মাত্র ১০০৷ তারপরও আমরা বেডের কথা চিন্তা না করে যেভাবে পারি রোগীদের চিকিত্সা দেয়ার কথা ভাবছি৷ চেষ্টা করছি আর কারুর যাতে জীবন না যায়৷''
আবাসিক চিকিত্সক ডা. পার্থ শঙ্কর পাল জানান, ‘‘গত ২৪ দিনে হরতাল-অবরোধের ফলে পেট্রোল বোমা এবং আগুনে ঝলসে গিয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি মোট ৮৬ জন হয়েছেন৷ তার মধ্যে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ছ'জন৷'' তিনি জানান, ‘‘শরীরের ৩০ ভাগের বেশি পুড়ে গেছে এ রকম রোগী আছেন ৪৭ জন৷ তাঁদের মধ্যে আটজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ তাঁদের শরীরের ৪৫ ভাগের বেশি পুড়ে গেছে, কয়েকজনের পুড়ে গেছে কণ্ঠনালীও৷ তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন ১৫ চিকিত্সক ও ২০ জন নার্স যোগ দিয়েছেন হাসপাতালে৷''
ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে আরো ১৩টি বার্ন ইউনিট থাকলেও, আগুনে পোড়া রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিত্সার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটই একমাত্র ভরসা৷ ফলে রোগীদের চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে এই ইউনিটকে৷ জনবল ও চিকিত্সা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে বাকি ১৩টি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের প্রাথমিক চিকিত্সা দেয়ার পর ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ কিন্তু স্থানান্তরিত করার সময় মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে রোগীর৷
একই সঙ্গে অভাব রয়েছে দক্ষ জনবলের৷ ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এ মুহূর্তে ১ হাজার ৫৫১ জন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন দরকার৷ অথচ বিষয়টিতে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক আছেন মাত্র ৫০ জন৷