বার্ধক্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াই যখন চল
৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮সে জন্যই বোধহয় এই মৃত্যুকে জয় করার সাধ, বার্ধক্যকে কয়েক বছর হলেও পিছিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন অনেকেরই৷
আর হবে নাই বা কেন ? কারণ, বিজ্ঞান তো সেই কবে থেকেই মানুষের এই স্বপ্ন পুরণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে৷ আবিস্কৃত হয়েছে নানা ধরনের ওষুধ, পথ্য আর রকমারি অস্ত্রপচারের ধারা - যার হাত ধরে মানুষের গড় আয়ুকে একটু একটু করে আরো একটু বাড়াতে চেয়েছেন ডাক্তার-বদ্যি বা বৈজ্ঞানিকরা৷ আগের তুলনায় মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিও পেয়েছে৷ কিন্তু, তার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে বার্ধক্যজনিত সমস্যাও৷
মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিতে শুধু যে মানবজাতিরই কল্যাণ হয়েছে তাই নয়, পসার বৃদ্ধি পেয়েছে ডাক্তারদের, এমনকি ব্যাঙ্কের বা জীবনবীমা কোম্পানিগুলিরও৷ ২০০০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যে ভারত-বাংলাদেশে এখন মানুষের গড় আয়ু ছাড়িয়েছে ৬০-এর ঘর৷ আফ্রিকার দেশগুলিতে এই সংখ্যা এখনো ৪০-র নীচে থাকলেও, জার্মানিতে এ-সংখ্যা এখন ৭০-এর উপরে আর জাপানে এই সংখ্যা বর্তমানে ৮০-রও উপরে৷ কিন্তু, এতে সমস্যাও আছে৷ জার্মানির মতো অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলিতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আয়ু বেড়ে যাওয়ায়, অর্থাত্ মৃত্যুর হার কমে যাওয়ায়, তাদের জন্য নানা রকমের বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে সরকারকে৷
অন্যদিকে, কম বা অল্প বয়সী মানুষদের সংখ্যা কম হওয়ায়, অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ঠিক মতো কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নিতে হয়েছে সরকারের৷ সম্প্রতি বার্লিনে এমনই একটি বিশেষ কংগ্রেসের আয়োজন করেছে জার্মান সরকার৷ যেখানে গড় আয়ুর এই সংখ্যাগত পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷
এই বাড়তে থাকা বয়স্ক জনসাধারণকে সমাজে জায়গা করে দিতে, বিশেষ সুযোগসুবিধে করে দিতে বার্লিনের ডেমোগ্রাফি কংগ্রেস - বেস্ট এইজ-এ আলোচনা হয়েছে অত্যাধুনিক বৃদ্ধাশ্রমের উপর, আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়, কিভাবে স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি করা যায় - এসবের উপরও৷
জার্মান সমাজে একদিকে জন্মের হার কমে যাওয়ায় এবং অন্যদিকে গড় আয়ু বেড়ে চলায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷ প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের মত নামী সংস্থা এবিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে দাবি করছে, যে জার্মানির শিল্প সংস্থাগুলি জনসংখ্যার এই বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের কাঠামোয় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হচ্ছে৷
কেন এই ব্যর্থতা ?
৫৩টি শিল্প সংস্থার কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ভবিষ্যতে তারা কীভাবে কর্মী নিয়োগ করবে - অর্থাত্ আগামী দিনে উপযুক্ত কর্মীর অভাব দেখা দেবে - এমন এক আশঙ্কার মুখে আজ তারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? জন্মের হার কমে যাওয়ায় কোনো এক সময় তরুণ-তরুণীর সংখ্যা কমে যাবে, যার ফলে শিক্ষিত ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর সংখ্যাও কমে যাবে৷ দেখা গেছে, বেশীরভাগ সংস্থাই সমাজের এই পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন - তবে এই সমস্যার মোকাবিলায় তারা যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷
অপেক্ষাকৃত বয়স্ক কর্মীদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হলেও নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে তরুণদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে৷ অর্থাত্ বয়স্ক প্রার্থীদের পক্ষে নতুন করে চাকরি পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে৷ এই মনোভাব ভবিষ্যতে কর্মীর চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷ প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের প্রতিনিধি টিল লোমান এবিষয়ে বললেন : এটা আসলে মানসিকতার প্রশ্ন৷ একদিকে রয়েছে বয়স্ক কর্মীদের নিজস্ব মানসিকতা, অন্যদিকে সংস্থার পরিচালকদের মানসিকতা৷ কর্মীদের নির্দিষ্ট সময়ের আগে অবসর গ্রহণে উত্সাহ না দিয়ে তাদের প্রতিটি স্তরে আরও গঠনমূলক কাজে জড়িয়ে ফেলতে পারলে সংস্থার উত্পাদনশীলতা বাড়বে৷ তাদের এই অবদানকে যথেষ্ট স্বীকৃতিও দিতে হবে৷
এই সঙ্কটের অশনী সঙ্কেত কিন্তু ইতিমধ্যেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে৷ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্মী পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ শুধু ইঞ্জিনিয়ার বা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী নয়, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দোকানদার থেকে শুরু করে মার্কেটিং - এই সব ক্ষেত্রে কর্মীর চাহিদা বেড়েই চলেছে৷ রেস্তোঁরার ওয়েটার, নার্স, ট্রাক চালকের চাহিদাও রয়েছে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বয়স্ক কর্মীরা অবসর নিতে শুরু করলে এই সব ক্ষেত্রে চাহিদা মেটানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে৷
শিল্প সংস্থাগুলির জন্য প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের পরামর্শ হল, সময় থাকতে বয়স্ক কর্মীদের বিদ্যে-বুদ্ধি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে৷ দুই প্রজন্মের মধ্যে ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে৷ অপেক্ষাকৃত বয়স্ক কর্মীদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে৷ বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা নিয়েও কিছুটা দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে৷ প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের প্রতিনিধি লোমানের মতে : আজকাল কমবয়সী কর্মীরা অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখতে চায় না৷ তারা অবসর সময়ে নিজেদের মনোরঞ্জন নিয়ে ব্যস্ত৷ তাদের কাছে টাকা নয় - জীবনে আনন্দ করাই অনেক বেশী জরুরী৷
জার্মানিতে সাধারণত পুরুষদের ৬৫ বছর বয়সে অবসর নিতে হয়৷ চিকিত্সার উন্নতি ও জীবনচর্যায় ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণে বেশীরভাগ মানুষই ঐ বয়সেও যথেষ্ট কর্মক্ষম থাকেন৷ অবসর জীবনেও তারা যথেষ্ট সক্রিয় থাকেন৷ এই প্রাণশক্তিকে আংশিকভাবে হলেও কাজে লাগাতে জার্মানিতে রয়েছে এক অভিনব উদ্যোগ৷ অবসরপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাতে SES নামে এক কাঠামোর মাধ্যমে উদ্যোগী বয়স্করা আজও নিজেদের মূল্যবান জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রয়োগ করেন অনেক প্রকল্পে - এমনকী বিদেশেও৷
অন্যদিকে, পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থায় পরিবারের ভাঙন যেন অনিবার্য হয়ে পড়ছে ! প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর বাবা-মায়ের প্রতি সন্তান তার যথাযথ দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করে রেখে আসছে হোম কেয়ার বা বৃদ্ধাশ্রম গুলিতে৷ আর বর্তমানে এই সত্য শুধু পশ্চিমা দেশগুলিতেই যে দেখা যাচ্ছে তা নয়, পাশ্চাত্যের এই সংস্কৃতি ভারত-বাংলাদেশেও স্থান পেয়েছে৷ সেখানকার অবস্থাও তথৈবচ৷ বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাদের হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার সেই ইতিহাস ভুলে বাবা-মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ বিদেশে অবশ্য সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও ভিন্ন৷ কারণ, সামাজিক নিরাপত্তা পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অনেক বেশি৷ এমনকি জার্মানিতেও বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন – এটাই স্বাভাবিক৷ কর্ম-জীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এজন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তাঁরা৷ কিন্তু, আমাদের দেশে ?
আমাদের দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলি আদতে কেমন ? কথা বলি বেসরকারী সংগঠন হেল্পএইজ ইন্ডিয়ার প্রোগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক অনুরাধা সেনের সঙ্গে৷ যিনি জানান, যে হেল্পএইজ ইন্ডিয়া কলকাতায় একটি বৃদ্ধাশ্রমও চালাচ্ছে৷