1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধর্মবিরোধী নয়

২৬ মার্চ ২০১৯

বাংলাদেশে কেউ কেউ ধর্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কিংবা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন৷ বিভিন্ন ঘটনায় এই অপচেষ্টার বড় প্রমাণ মিলেছে৷

https://p.dw.com/p/3FZAU
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও এদেশকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র' বানিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে ধুয়া উঠেছিল৷ এ দেশে শুধু নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ধর্মের ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক বিষয়৷ ইতিহাসে যেমন বারবার এর বড় বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে, আজও তা ঘটছে৷

কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমার কাছে এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যেখানে ‘প্রচার' থাকলেও ধর্ম মুক্তির ডাকে বাধা হয়ে আসেনি৷ বরং ধর্ম শক্তি যুগিয়েছে৷

এখানকার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা অন্য ধর্মের লোকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেমন যুদ্ধ করেছিলেন, তেমনি ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা জায়নামাজ খুলে কিংবা হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ, ভগবান ও প্রভুর দিকে অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রার্থনার হাত তুলেছেন৷ তারা কিন্তু শুধু মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিংবা হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রার্থনা করেননি৷ তাহলে যারা ধর্মের দোহাই দিচ্ছিলেন তারা কেন দিচ্ছিলেন? 

মূলত তখন পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের রাজনৈতিক হাতিয়ার ছিল ইসলাম ধর্ম৷ কারণ, ধর্মের ভিত্তিতেই ৪৭-এর সময়ের হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত ভূখন্ডের স্পষ্ট রাজনৈতিক বিভাজনেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা হলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের সঙ্গে থাকবে না৷ তাই তখন বাংলারও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি সাধারণ বাঙালিদের দু'ভাগে ভাগ করতেন৷ উর্দু ভাষা বলতে পারেন এমন ‘সাচ্চা মুসলমান' ও যারা বলতে পারেন না তেমন নিম্নস্তরের বাঙালি৷

আরো একটা বিষয় হলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান যে সময়টায় তার কিছু আগেই উপমহাদেশে হিন্দু ও ইসলামি জাতীয়তাবাদের চরম উত্থান ও পারস্পরিক সংঘর্ষ হয়৷ সেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানেই পাকিস্তানের জন্ম৷ তাই যারা এই ইসলামি জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই এই পরিবর্তন তারা সহজে মেনে নিতে পারলেন না৷ তাই মতবাদ ও আদর্শিক জায়গা থেকেও বাধা এলো৷ কিন্তু তাদের এ রাজনীতি ধোপে টেকেনি, বৈষম্যের শিকার বাঙালিদের ওপর৷ 

কিন্তু সেই রাজনীতি কি চলে গেছে? না যায়নি৷ এই ধরনের মনোভাব সমাজের গভীরে প্রথিত৷ এখনও আমাদের চারপাশেই অনেককে দেখা যায়, বাঙালিপনাকে ‘বিধর্মীর কাজ' বলতে৷ এখনও দেখা যায়, যেসব গণসংগীত মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে, শক্তি যুগিয়েছে, যেসবের সঙ্গে বাঙালির আত্মার যোগ, সেগুলোকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করাতে৷ এখনো দেখা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিবসগুলো পালন নিয়েও অনেকেই দ্বিধাবিভক্তিতে ভোগেন৷

তাই তাদের সবার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার তা হলো, স্বাধীনতা আন্দোলনের বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনো ধর্মবিরোধী নয়৷ পরিষ্কার করে এ-ও বলা দরকার, কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিতে চান, স্বার্থ হাসিলের জন্য

এখানে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানদের কথা বলা হচ্ছে না৷ তারা রাজনীতিটা বোঝেন না৷ তাদের ধর্মের প্রতি আনুগত্যকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করেন কিছু মানুষ৷ উদাহরণ দেবার জন্য খুব বেশি দূর যেতে হবে না৷ ২০১৩ সাল অব্দি গেলেই হবে৷ সে সময় কিছু মানুষ ও একটি গণমাধ্যম খুবই সূক্ষ্মভাবে ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিতে চেয়েছিল৷ মূল উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভন্ডুল করা৷

তাই শাহবাগে যারা গিয়েছিলেন এবং শাপলা চত্বরে যারা গিয়েছিলেন তাদের আমরা মুখোমুখি অবস্থান দেখলাম৷ ব্লগার মানেই নাস্তিক, শাহবাগে যারা গেলেন তারা নাস্তিক, এমন প্রচারণা ব্যাপক আকার ধারণ করল৷ শাহবাগ নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে, সে আলোচনা ভিন্ন৷ কিন্তু শাহবাগে যারা গিয়েছিলেন তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে গিয়েছিলেন, ধর্মের বিরোধিতা করতে নয়৷ 

অন্যদিকে, যারা শাপলা চত্বরে গেলেন, অনেকেই ভাবলেন এদের ব্যবহার করে সরকার নামিয়ে দেয়া যাবে৷ দেশে বড় কিছু একটা করে ফেলা যাবে৷ সেখানে গিয়ে হাজিরা দেয়া শুরু করলেন৷ আওয়ামী লীগকেও প্রথমে দেখা গেল উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে, এরপরই দেখা গেল অবস্থান বদলে দুই নৌকায় পা রাখতে৷ সবই রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য৷ 

HA Asien | Zobaer Ahmed
যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে

রাজনীতি এতই পরিবর্তনশীল একটা বিষয় যে, এর লক্ষ্য আসলে কী তা নির্ধারণ করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি৷ কিন্তু সামাজিকভাবে ‘রাজনৈতিক' কিছু বিষয়ে পরিষ্কার থাকা খুব জরুরি৷ তা না হলে আমাদের সবসময় বিভ্রান্ত করা হবে৷ আমরা সবসময় বিভ্রান্ত হব৷ বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক নন৷ বাংলার মানুষ আবেগী৷ সেই আবেগের জোরেই অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে ‘পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি' এসেছে৷ কিন্তু ধর্মের অপব্যাখ্যা এই মুক্তির আবেগকে যেমন থামাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও যেন এই মুক্তির চেতনার মাঝে যেন না আসতে পারে সেটা আমাদেরই খেয়াল রাখতে হবে৷

সারাবিশ্বে যেভাবে বর্ণবাদ ও উগ্রবাদকে পুঁজি করে ‘আদর্শিক ঘৃণা' ছড়ানো হচ্ছে, তার বিপরীতে সাধারণ মানুষকে দাঁড়াতে হবে৷ কারণ এটা বুঝতে হবে যে ধর্মের কারণে হোক, বর্ণের কারণে হোক ঘৃণা কোনো আদর্শ হতে পারে না৷ আর কোনো সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দল তা করে দিতে পারবে না, আরো পরিষ্কার করে বলা ভালো যে, তারা করবে না৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷