বাংলাদেশের স্টল নেই, তবে ‘বাংলিশ' বই আছে
১৩ অক্টোবর ২০১৪শুধু আকারে-আঙ্গিকে বড় মেলা বলেই যে বইমেলা শুরু হলে ফ্রাংকফুর্টে উৎসবের রং লাগে তা ভাবা ঠিক নয়৷ লোকে যতই ‘যান্ত্রিক' বলুক না কেন, আসলে কিন্তু জার্মানরা খুব আমুদে৷ তাই তাঁদের কাছে সপ্তাহান্ত মানেই ছোটখাটো উৎসব৷ এমনিতে প্রতি শনিবার জার্মানদের চোখে-মুখে, পোশাক-আষাকে আনন্দের ঝিলিক বিকেল গড়ালে বেশি লাগলেও এই শনিবার ফ্রাংকফুর্ট সে নিয়ম ভুলেছিল৷ সকালে ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছাড়াতে-না-ছাড়াতেই স্টেশনে-ট্রামে-রাস্তায় গিজগিজে ভিড়৷ বাচ্চাগুলোর দিক থেকে তো চোখ ফেরানোই দায়৷ কেউ সেজেছে পশু-পাখি, কেউ বা জণপ্রিয় কোনো কার্টুন চরিত্র৷ কল্পনার মিঠেপানিতে এভাবে একটু ডুব না দিলে খুদে জার্মানদের কোনো আনন্দই যেন জমে না৷
সপ্তাহের শেষ দুটো দিন ফ্রাংকফুর্টের স্থানীয় বা দেশি-বিদেশি অতিথি – সবার জন্যই ছিল ‘স্পেশ্যাল'৷ জার্মানদের পাঠপ্রীতি বরাবরই নজর কাড়ে৷ জার্মানির সব শহরের ট্রামে-বাসে, স্টেশনে, পার্কেই বই বা ই-বুক হাতে কিছু মুখ সবসময় চোখে পড়ে৷ এমন মানুষদের এক শহরে ‘বুখমেসে', অর্থাৎ বইমেলা শুরু হয়ে শেষও হতে চলেছে৷ মনে ধিতাং-ধিতাং বোল তো উঠবেই!
৮ থেকে ১২ অক্টোবর – এই পাঁচদিনের বইমেলার শেষ দুটো দিন ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত৷ তার আগে শুক্রবারটা ছিল আবার ‘কিডস ফ্রাইডে', অর্থাৎ শিশুদের জন্য বিশেষ দিন৷ শনিবারও অবশ্য তাদের কদর কমেনি৷ সকাল থেকেই শুরু ট্রেনে-ট্রামে-বাসে, নিজের গাড়ি কিংবা ভাড়া করা ট্যাক্সি, নয়ত সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে মেলার দিকে ছোটা৷ চার-পাঁচজনের এমন একটা দলও দেখিনি যেখানে একজন শিশু বা কিশোর নেই৷
হাউপ্টবানহোফ, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন থেকে মেলায় কীভাবে যাব? এই তথ্যটুকু পেতে কোনো কষ্টই হলো না৷ পাঁচটা দিন রেল স্টেশনের তথ্য কেন্দ্রের কাজই তো সবাইকে পঁই পঁই করে বলে তা বুঝিয়ে দেয়া৷ একটা নির্দিষ্ট প্লাটফর্ম থেকে সারাদিন যতগুলো ট্রাম ছাড়বে সবই যাবে বইমেলায়৷ বিশেষ দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এমন সুপরিকল্পিতভাবে জনসেবায় নিয়োজিত করা! একুশে বইমেলার অভিজ্ঞতা মনে পড়ল৷ হায় রে, বাংলাদেশে কবে যে এমন হবে!
কোনো কোনো বার ‘নামকা ওয়াস্তে' হলেও বাংলাদেশের স্টল থাকে৷ এবার তা-ও নেই৷ তাই মেলায় পৌঁছেই শুরু হলো ‘প্রেসবক্স' খোঁজা৷ দিকনির্দেশনা দেখে দেখে হাজির হলাম৷ ‘প্রেস কিট'-এর সঙ্গে পাওয়া কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে বোঝা গেল, আয়োজকরা সাংবাদিকদের পেশাদারি প্রয়োজন এবং কৌতূহল মেটানোর সব ব্যবস্থাই মোটামুটি করে রেখেছেন৷ বইমেলা মানেই বই, লেখক, প্রকাশক আর পাঠকদের উৎসব৷ এমন উৎসবকে পরিপূর্ণতায় রূপ দেয়ার আন্তরিক প্রয়াসের দৃষ্টান্ত হতে পারে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলা৷
কী নেই এ মেলায়? নেই যে কোনো বই নগদে কেনার সুযোগ৷ বিক্রির বই হাতে গোনা এবং বাছাই করা৷ তা-ও সব স্টলে নয়৷ তুর্কি ভাষার বইয়ের স্টলে নাসিরউদ্দীন হোজ্জাকে দেখে চমকে গেলাম৷ মুশকিল হলো, তুর্কি আর জার্মান ছাড়া আর কোনো ভাষার সংস্করণ নেই৷ বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে স্টলের এক তরুণ খুশি হয়ে বলে উঠেছিল, ‘‘আমাদের কাছে একটা বাংলিশ বই আছে৷'' বাংলাকে ‘বাংলিশ' বলতে শুনে হাসি পেলেও হাসি চেপে বইটা দেখতে চাইলাম৷ দুর্ভাগ্য আমাদের, অনেক চেষ্টা করেও সুদর্শন তুর্কি তরুণ বইটি আর খুঁজে পেল না৷
বাংলাদেশের স্টল বা তুর্কিদের স্টলে বাংলা বই না দেখার মতো বিষয় ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় একটু ঘুরলেই ভুলে যাওয়া যায়৷ এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যেতেই অনেক ঝক্কি ৷ লিফ্ট, এস্ক্যালেটর বা চলন্ত সিঁড়ি সবই আছে, তবুও হাঁটতে হাঁটতে একসময় পা আর চলতে চায় না৷ বসে জিরিয়ে নেয়ার মতো জায়গা বা আয়োজনের অভাব নেই৷ তা ছাড়া আরাম করে বসে বই পড়া যায় এমন স্টলও তো আছে অনেক৷ পড়তে পড়তে পিঠে ব্যথা শুরু হয়েছে? নো চিন্তা৷ আছে ফিজিওথেরাপিস্ট৷ একজন-দু'জন নয়, এক ঝাঁক ফিজিও থেরাপিস্ট ছিল এবারের মেলায়৷ তাঁদের একজনকে ১০ ইউরো দিলে ১০ মিনিটেই ব্যথা উধাও৷ ফিজিওথেরাপিস্টের ‘মাসাজ' বলে কথা!
এক প্রকৌশলীর সঙ্গেও দেখা হয়েছে৷ জার্মান এক প্রকৌশলী৷ এসেছিলেন নিজের তৈরি দুটো প্রডাক্ট নিয়ে৷ টেলিফোন বুথের মতো একটা ঘর আর এক ধরনের দুটো চেয়ার৷ ঘরটায় ঢুকে বই পড়লে বা টেলিফোনে কথা বললে বাইরের কোনো আওয়াজ ভেতরে আসবে না, ভেতরের আওয়াজও বাইরে যাবে না৷ চেয়ার দুটো আরো অদ্ভুত৷ যে বসবে তাঁর মাথার ওপরে শুধু একটু ছা্উনি থাকবে৷ তাতেই চেয়ারটা ‘সাউন্ড প্রুফ'৷ গান গাইতে গাইতে, না হয় শুনতে শুনতে বই পড়ুন, আপনার গান বাইরের কেউ শুনবে না, আপনার কানেও বাইরের কোনো কোলাহল যাবে না৷ সিমেন্সসহ জার্মানির বেশ কিছু কম্পানি নাকি এই প্রডাক্ট দুটো কিনছে৷
ভেবে রেখেছিলাম, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলায় গিয়ে বাংলাদেশের বইমেলার কথা যতটা সম্ভব ভুলে থাকবো৷ দেশে এত নামি-দামি প্রকাশক, অথচ কারো একটা স্টলও নেই, বাংলাদেশের একটা বইও আসেনি এ মেলায় – এ সব জানার পর একুশে মেলার কথা না ভাবাই ভালো মনে হলো৷ কিন্তু ফেরার সময় বাংলাদেশের বইমেলার কথা ভাবতেই হলো৷ যত বড়ই হোক, দেখলাম, ফ্রাংকফুর্টের মেলাও এক জায়গায় অন্তত একুশে বইমেলার মতো৷ বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বহুবার দেখেছি, ‘জাঁদরেল' প্রকাশনীগুলোর স্টলের সামনে শত লোকের ভিড় জমেছে, অথচ পাশের কিছু স্টলে কাকপক্ষীটিও নেই৷ ফ্রাংকফুর্টে শিশুদের বইগুলো ঘিরে ছিল অবাক করা গাদাগাদি৷ আবার ঠিক পাশের ভবনে এমন স্টলও দেখেছি, যেগুলোর দিকে ভুল করেই বোধহয় কেউ কেউ ফিরে তাকায়৷
এক স্টলে এক বৃদ্ধাকে দেখে মনে হলো, তাঁর কাছে কেউ আসবে এ আশা তিনি ছেড়েই দিয়েছেন৷ এমনি এমনি কাহাঁতক বসে থাকা যায়! এক সময় ব্যাগ থেকে টুক করে কুশিকাঁটা বের করে কী যেন বুনতে শুরু করলেন৷ একুশে বইমেলায় এমন স্টলগুলোতে অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাঠকপ্রিয় কিছু বইয়ের নীলক্ষেত সংস্করণ থাকে৷ সেই সুবাদে কয়েকজন ক্রেতাও জোটে৷ ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার কোনো স্টলে এমন কিছু ভাবাও ‘পাপ'৷ তাই এখানে ‘নেই কাজ তো খই ভাজ', থুড়ি, ‘নেই কাজ তো কুশিকাঁটায় মন দেয়াই শ্রেয়'!