বাংলাদেশের বন্যায় প্রকৃতি ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোর দায়
বন্যা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ প্রতিবছর দেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিমি বা ১৮ শতাংশ ভূখন্ড প্লাবিত হয়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে নতুন কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে৷
সাত বছরে একবার
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, যেগুলো ব্যাপকতায় ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার প্রায় সমান৷ ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ছয়-সাত বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে৷ ১৯২৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি সাত বছরে একবার ব্যাপক বন্যা আর ৩৩-৫০ বছরে একবার মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা হয়৷
ভয়াবহ যত বন্যা
১৯৬৮ সালে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় সাত লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ ১৯৮৭ সালে সারা দেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়৷ ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হলেও ১৯৮৮ সালের বন্যা গত শতকের অন্যতম ভয়াবহ, যাতে ৬০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাপক প্রাণহানি হয়৷ এছাড়া ১৯৯৮ সালে দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দুই মাসের বেশি বন্যা কবলিত থাকে, যা ১৯৮৮ সালের বন্যার সঙ্গে তুলনীয়৷ ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালেও ভয়াবহ বন্যায় পড়ে বাংলাদেশ৷
প্রাকৃতিক, নাকি মানবসৃষ্ট?
বন্যার যেসব কারণের কথা বলা হয় তার মধ্যে রয়েছে: ভারি বৃষ্টিপাত, হিমালয়ের তুষার গলা, পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট/দখল বা ভূমিধ্বস, প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি, প্রকৃতির উপর মানবীয় হস্তক্ষেপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব৷
'উন্নয়ন': নতুন সংকট
সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার জন্য অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকেও দায়ী করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র চলতি মাসের সংবাদ সম্মেলন অনুযায়ী, মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদী আছে৷ ভারত ইচ্ছেমতো সেখানে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিচ্ছে৷ উন্নয়নের নামে সিলেটের হাওর অঞ্চল ভরাট, রাস্তা, বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহে বাধা দেয়াকেও চলতি বন্যার কারণ হিসেবে অভিহিত করেছে তারা৷
ব্যবস্থাপনায় গলদ
বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্প মূলত বাঁধ, পোল্ডারের মতো অবকাঠামো নির্ভর৷ কাঠামোগত পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা, সেই সঙ্গে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথের মতো অন্যান্য স্থাপনাসমূহ পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে৷ এর প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে দেশে বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পসমূহে প্রচুর বিনিয়োগ সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে ফলাফল সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
প্রতিরোধ পরিকল্পনা
১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার৷ কাঠামোগত প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং বন্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১১টি নির্দেশনামূলক নীতি প্রণয়ন করা হয়৷ এর অংশ হিসেবে বর্তমানে প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করছে সরকার৷ মুনাফা ও নিরাপত্তার দিক থেকে উপকারিতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের৷
যা প্রয়োজন...
কাঠামোগত পদক্ষেপের বাইরে বিকল্প কৌশল হিসেবে অ-কাঠামোগত পদক্ষেপগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এর মধ্যে আছে নদ-নদীর উপচে পড়া পানি হ্রাসের জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগসহ শস্যের বহুমুখীকরণ৷ আর সবশেষ প্লাবনভূমিগুলোকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা৷