সংবাদভাষ্য: কালো মেঘ কাটেনি
৭ জানুয়ারি ২০১৪বিরোধী দলের সহিংস প্রতিবাদ এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর অভিযানের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় লাভ করেছে৷ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনুষ্ঠিত এটাই প্রথম নির্বাচন, যা বাংলাদেশিদের মধ্যে গভীর বিভাজন এবং রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত দু'পক্ষের মধ্যে গণতন্ত্রের মূল নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধার অভাব স্পষ্ট করে তুলেছে৷
গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা এবং প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকেই ঘুরে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে দেখেছে বাংলাদেশ৷ কিন্তু দেশের রাজনীতির এই দুই নারী নেত্রীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ব্যাপারটি একেবারেই নেই৷ নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর আগে এক টেলিফোন কথোপকথনে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে তাঁরা রাজনৈতিক বিরোধকে বরং ব্যক্তিগত বিরোধের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন৷ এ বিরোধ তাঁদের এতটাই অন্ধ করেছে যে দেশের প্রয়োজনও তাঁদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না৷ দু'জনের একজনও জাতীয় স্বার্থে আপোষ করতে রাজি নন৷ তাই বিএনপি অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা সম্পন্নও করেছে৷ এভাবে দু'পক্ষই অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের অধিকার থেকে দেশের জনগণকে বঞ্চিত করেছে৷
হাসিনা এবং খালেদা দু'জনই দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এসেছেন পারিবারিক সূত্রে৷ দল দুটি গণতান্ত্রিকভাবে মত প্রকাশের ধারা সৃ্ষ্টির জন্য কাজ করে না, দলকে ব্যবহার করায় হয় ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থে৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, দেশে দুর্নিতি বেড়েই চলেছে৷ এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, কয়েক দশক ধরেই এ অবস্থা চলছে বাংলাদেশে৷
চলমান সংকটের মূল কারণ তিনটি৷ প্রথম কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনকে সম্ভব করতে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ছাড়ায় অস্বীকৃতি জানানো৷ ক্ষমতাসীন সরকারই যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে, সেখানে কার্যকর গণতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা কখনো স্বাভাবিক নয় – আওয়ামী লীগ খুব যৌক্তিকভাবেই এ প্রশ্ন তুলতে পারে৷ কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে যা দেখেছি, তাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা উপলব্ধি করার উপায় নেই, কারণ, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে দলগুলো পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেনা৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থায় গেলে হয়ত প্রতিবাদও কম হতো৷
দ্বিতীয় কারণ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু করা৷ সেই যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, ধর্ষিত হয়েছিল ৩ লক্ষের মতো নারী৷ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বর্ণবাদের ক্ষত মুছতে নোবেল বিজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা যে ‘ট্রুথ কমিশন' গঠন করেছিলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাংলাদেশ সেই মডেল সামনে রেখে কাজ করতে পারতো৷ তা না করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির বিধানও রাখা হয়েছে৷ ট্রাইব্যুনালের আইনে ফাঁসির বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে সংসদে নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে হয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং জাতিসংঘ এর নিন্দা জানিয়েছে৷ বাস্তবতা হলো, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অভিযোগে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা৷ অতীতে বিএনপি সরকারের অংশীদার ছিল দলটি৷ বিচারে সরকারের পক্ষপাতসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারপর অবধারিতভাবেই শুরু হয় ব্যাপক প্রতিবাদ এবং সহিংসতা৷
তৃতীয় কারণ, মৌলবাদী ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীকে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা৷ এটা ছিল মারাত্মক ভুল৷ যেহেতু জামায়াতকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা এবং জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি করার পেছনে রয়েছে সরকার, তাই জাতীয় নির্বাচনে কখনো শতকরা দশভাগ আসনও না পাওয়া দলটি রাজনৈতিক জবাব দেয়ার পথ না ধরে নেমে পড়ে নিজস্ব ভঙ্গির সহিংস আন্দোলনে৷ বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ নাগরিক মুসলমান হলেও দেশটিতে মৌলবাদী দল কখনো ক্ষমতায় আসেনি৷ দেশটি চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ ঘরাণার এবং সাংবিধানিকভাবেও পাকিস্তানের মতো ইসলামি প্রজাতন্ত্র নয়৷
আওয়ামী লীগ মনে করে, শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি শাসন কায়েমের পরিকল্পনা করছে জামায়াত৷ জামায়াত সম্পর্কে এমন দুশ্চিন্তা যে যৌক্তিক এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ কিন্তু জামায়াতকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্তের পেছনে এই দুশ্চিন্তাই কি কাজ করেছে? অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, বিএনপি যাতে জোট সরকার গঠন করলে এমন একটি অংশীদার না পায়, সেটা নিশ্চিত করার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিল আওয়ামী লীগ৷
দু'পক্ষের মধ্যে এখনো কোনো রকমের সমঝোতার মনোভাব দেখা যাচ্ছে না বলে বাংলাদেশ যে খুব শিগগির চলমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে, সে আশা খুবই ক্ষীণ৷ আন্তর্জাতিক চাপ নিশ্চিতভাবেই বাড়বে৷ কারণ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো যে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি সে কথা ভুলে গেলে চলবে না৷
শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলেও এ জয় এসেছে দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিলীতার সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে৷ এবং বেশ কয়েক দফা সেনা শাসনের অধীনে থাকা দেশটিতে ক্ষমতা আবারো নিজেদের হাতে নেয়ার জন্যই যেন অপেক্ষা করছে সেনাবাহিনী৷
প্রতিবেদন: গ্রেহেম লুকাস
অনুবাদ: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ