বাংলাদেশে ১২ সংসদ: সরকার, বিরোধী ও গণতন্ত্র
কখনো সংসদে নেই বিরোধী দল, কখনো নেই নির্বাচনেই। কখনো নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল, কখনো একই দল বিরোধী এবং সরকারের ভূমিকায়। নির্বাচনে নানা ধরনের নাটকীয়তার তথ্য জানুন ছবিঘরে।
১৯৭৩: প্রথম সংসদে ছিল না বিরোধী নেতা
৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসনে জয় পায় আওয়ীমী লীগ। জাসদ একটি, জাতীয় লীগ একটি এবং স্বতন্ত্ররা পান পাঁচটি আসন। ভোট পড়েছিল ৫৪.৯। উল্লেখযোগ্য আসন না থাকায় ছিলেন না কোনো বিরোধী দলীয় নেতা। সেই সময় সাতজন সংসদ সদস্য বিরোধী দল গঠনের দাবি করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা প্রত্যাখ্যান করেন। আড়াই বছর পর সংসদ ভেঙে দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন করা হয়, গঠন করা হয় একক দল বাকশাল।
১৯৭৯: বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ
৫১.৩% ভোটার উপস্থিতিতে নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগে গঠিত বিএনপি ২০৭ আসন জিতে সরকার গঠন করে। ৫৪ আসন জিতে আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান নেয়, দলের সভাপতি আসাদুজ্জামান খান হন বিরোধী নেতা। মুসলিম লীগ ২০টি, জাসদ ৮টি এবং অন্যান্য দল পায় ১০টি আসন। ১৯৮১ সালে সেনা কর্মকর্তাদের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হন। ১৯৮২ সালের মার্চের পর দ্বিতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়, ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ।
১৯৮৬: বিএনপির বর্জন, বিরোধী আওয়ামী লীগ
নিজের দল জাতীয় পার্টি গঠন করে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি, আওয়ামী লীগ ৭৬টি আর জামায়াতে ইসলামী ১০টি আসন পায়৷ বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছিল৷ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১.১%। আন্দোলনের মুখে ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ বাতিল করেন এরশাদ।
১৯৮৮: প্রধান বিরোধীদের বর্জন, সম্মিলিত বিরোধী দল
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ প্রায় সবকয়টি প্রধান বিরোধী দল এরশাদের অধীনে নির্বাচন বয়কট করে। জাতীয় পার্টি পায় ২৫১টি আসন। বেশ কয়েকটি নতুন তৈরি হওয়া দলের হয়ে নির্বাচিত হয়ে আসা সংসদ সদস্যদের নিয়ে তৈরি হয় ১৯ সদস্যের সম্মিলিত বিরোধী দল। কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি-কপ নামের ওই বিরোধী দলের নেতা করা হয় আ স ম আবদুর রবকে। নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৫২.৫%।
১৯৯১: নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন
ব্যাপক আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন এরশাদ। সংবিধানে তখনও ছিল না নিরপেক্ষ সরকারের বিধান। কিন্তু সব দলের সম্মতিতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে হয় নির্বাচন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয় লাভ করে ১৪২ আসনে, আওয়ামী লীগ ৮৮টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পায়, বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৫.৪%। এছাড়া, জাতীয় পার্টি ৩৫ এবং জামায়াতে ইসলামী পেয়েছিল ১৮টি আসন।
১৯৯৬: আবার বর্জন, বিরোধী নেতা বঙ্গবন্ধুর খুনি
এই নির্বাচন বেশি পরিচিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নামেই। অধিকাংশ বিরোধী দল নির্বাচনটি বর্জন করে, ভোটদানের হার ছিল মাত্র ২১%। বিএনপি জিতেছিল ২৭৮ আসনে। ফ্রিডম পার্টির হয়ে একটি আসন জিতেছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ৷ স্বতন্ত্ররা জয়ী হয়েছিলেন ১০ আসনে। বাকি ১১টির মধ্যে ১০টি আসনের ফলাফল ‘অসমাপ্ত' থাকে ও আদালতের রায়ে একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়।
১৯৯৬: তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন
আগের সংসদ টিকেছিল মাত্র ১১ দিন। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে ১২ জুন দেয়া হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৪৬ আসনে জেতে আওয়ামী লীগ, ১১৬ আসন পায় বিএনপি। ৩২ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ, বিরোধী দলের নেতা হন খালেদা জিয়া।
২০০১: জোটের নির্বাচনে বিএনপি
এটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বিতীয় নির্বাচন। ১৯৯৯ সালেই জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে চার দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। এরশাদ জোট ত্যাগ করলেও নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টির একটি অংশ থেকে যায় জোটে। বিএনপি একাই ১৯৩ আসনে জয় পায়, ইসলামী ঐক্যজোট ২টি এবং জামায়াত পায় ১৭ আসন। আওয়ামী লীগ পায় ৬২ আসন। বিএনপির সঙ্গে সরকারে যোগ দিয়েছিল জামায়াত।
২০০৮: সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ, গ্রেপ্তার হাসিনা-খালেদা
সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ায় বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগ। রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী, গঠিত হয় সেনাসমর্থিত সরকার। গ্রেপ্তার করা হয় শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে, অভিযোগ ওঠে এই দুই নেতাকে রাজনীতি থেকে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ পায় ২৩০, জাতীয় পার্টি পায় ২৭ আসন। চার দলীয় জোটে বিএনপি পায় ৩০ আসন।
২০১৪: বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা
বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ফলে নির্বাচনের আগেই সরকার গঠন নিশ্চিত ছিল আওয়ামী লীগের। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি পায় ৩৪ আসন। এই সংসদে জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে ছিল বিরোধী দল এবং সরকারে। রওশন এরশাদ হন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা, মন্ত্রিসভায় ছিলেন তার দলেরই তিন জন।
২০১৮: বিএনপির অংশগ্রহণ, ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ
বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক ঐক্য গঠন করা হয়। এরশাদ বারবার মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা ২৮৮টি আসন পায়। আর বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র সাতটি। ২০১৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিরোধী নেতা ছিলেন এরশাদ, এরপর তার স্ত্রী রওশন এরশাদ।
২০২৪: ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্বতন্ত্র
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে এত স্বতন্ত্র প্রার্থী কখনো নির্বাচিত হননি। আওয়ামী লীগ জিতেছে ২২২ আসন, স্বতন্ত্ররা ৬২ আসন এবং জাতীয় পার্টি জিতেছে ১১ আসনে। বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বর্জন করা নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসাবে লড়াই করে জয়ী হওয়াদের বেশিরভাগই বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা। দুটি আসনে নির্বাচন স্থগিত হয়েছে। এবারও জাতীয় পার্টিই বিরোধী দল হবে, নাকি স্বতন্ত্ররাই জোট করবেন তা এখনো জানা যায়নি।