বাংলাদেশে ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র বিক্রি বন্ধ করেছে ইসরায়েল
১৮ আগস্ট ২০২১বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (ব়্যাব) ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান সেলেব্রাইট-এর তৈরি ফোনে আড়িপাতার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিনা এ নিয়ে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন ধরে৷ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ করে ইসরায়েলের আদালতে পিটিশনও করা হয়েছে, যাতে সেলেব্রাইট দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে নজরদারি প্রযুক্তি রপ্তানি বন্ধ করে৷
সেলেব্রাইটের এক মুখপাত্র বুধবার জানিয়েছেন যে, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷ ডয়চে ভেলেকে ইমেলে তিনি বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য বা ইসরায়েল নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কিংবা ‘ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’-এর কালো তালিকায় আছে এমন কোনো দেশে কিছু বিক্রি করে না সেলেব্রাইট৷ আমরা এমন ক্রেতাদের সাথে ব্যবসা করি, যারা আমরা বিশ্বাস আইন মেনে কাজ করে এবং গোপনীয়তার অধিকার বা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘উদাহরণস্বরপ বলতে পারি, আমরা বাংলাদেশ, বেলারুশ, চীন, হংকং, ম্যাকাও, রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যার আংশিক কারণ হচ্ছে, দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সেখানে তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে৷’’
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হতে দেশটির সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)-কে বেশ কিছু তথ্য প্রদান করেছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানটি৷ এসইসি'র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সেসব তথ্যের মাঝে সেলেব্রাইট এটাও উল্লেখ করেছে যে, রাশিয়া এবং বাংলাদেশসহ কিছু দেশে পণ্য বিক্রি বন্ধের দাবিতে ইসরায়েলি আদালতে পিটিশন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের কারণে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়ে থাকতে পারে৷
‘‘খদ্দেররা আমাদের পণ্যের অন্যান্য অপব্যবহার করেছে- এমন অভিযোগ ভবিষ্যতেও আমাদের সুনাম ক্ষুন্ন করতে পারে, এমনকি যদি আমরা সেই অপব্যবহারের কোনোরকম অংশীদার না-ও হই বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদে দ্রুত পদক্ষেপ নেই, তারপরও...,’’ জানিয়েছে সেলেব্রাইট৷
ফোন হ্যাকিং-এর আধুনিক প্রযুক্তি তৈরি করে সেলেব্রাইট
গত ১৭ মে এসইসি ওয়েবসাইটে এসব তথ্য প্রকাশিত হলেও সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রভাবশালী হারেৎস পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে বিষয়টি অনেকের নজরে আসে৷
হারেৎস লিখেছে, ‘‘সেলেব্রাইট বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ‘ডিজিটাল ফরেনসিক' সমাধান বিক্রি করে৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পণ্যের নাম হচ্ছে ‘ইউনিভার্সেল ফরেনসিক এক্সট্রাকশন' ডিভাইস৷ এই ডিভাইস ব্যবহার করে ‘লকড' থাকা মোবাইল ফোনের বিভিন্ন তথ্য এবং সেটির অবস্থান ফোনটির মালিকের অনুমতি ছাড়াই সংগ্রহ করা যায়৷''
পত্রিকাটি আরো লিখেছে, ‘‘সেলেব্রাইটের মূল খদ্দের পশ্চিমা বিভিন্ন পুলিশ বাহিনী হলেও এটি অন্যত্রও এই ডিভাইস বিক্রি করে, যার মধ্যে এখনো পর্যন্ত অন্তত বাংলাদেশও রয়েছে৷''
বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী ব়্যাব, যেটির বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকের গুম করার অভিযোগ রয়েছে, সেলেব্রাইটের ফোন হ্যাকিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বলেও লিখেছে হারেৎস৷
বাংলাদেশের অস্বীকার
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অবশ্য ইসরায়েলের কাছ থেকে ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র কেনার খবর অস্বীকার করেছেন৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের তো এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে, তাদের কাছ থেকে আমরা আড়িপাতার যন্ত্র আমদানি করবো৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আড়িপাতার যন্ত্রের কথা আমরা জানি না৷ ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-এর যন্ত্রপাতি আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করি৷’’
সেলেব্রাইটের তৈরি নজরদারি প্রযুক্তি ব়্যাব ব্যবহার করে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘ব়্যাব যা ব্যবহার করে, তা আমরা ওদের (ইসরায়েল) কাছ থেকে কোনোদিনই আমদানি করিনি৷’’
ইসরায়েলি আদালতে পিটিশন, গণমাধ্যমের চাপ
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ইসরায়েলের তৈরি নজরদারি উপকরণ ব্যবহার করছে – এরকম প্রতিবেদন ইসরায়েলি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে৷
ইসরায়েলের মানবাধিকার আইনজীবী এইটেই ম্যাক এবং ৮৪ জন সাধারণ ইসরায়েলি চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশে ইসরায়েলি নজরদারি প্রযুক্তি রপ্তানি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে পিটিশন দাখিল করে৷
জেরুসালেম শহরের বাসিন্দা এইটেই ম্যাক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গোটা বিশ্বে পরিচিতি রয়েছে৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেখ হাসিনা সরকার বাকস্বাধীনতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড সীমিত করতে বিভিন্ন আইন পাস করেছে৷’’
‘‘আমি মনে করি, ইসরায়েলি ফোন হ্যাকিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সরকারের সমালোচনা করা অ্যাক্টিভিস্ট, সংগঠন, লিঙ্গ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ যারা দুর্নীতি বন্ধে কাজ করছেন তাদের কাজকর্মকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হতে পারে,’’ বলেন তিনি৷
ইসরায়েলের আদালত অবশ্য সেলেব্রাইটকে বাংলাদেশে প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানি বন্ধে কোনো নির্দেশনা দেয়নি৷ তবে আদালতে পিটিশন দাখিলের ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটি নিজ উদ্যোগেই বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ব্যবসা না করার ঘোষণা দেয়৷
এইটেই ম্যাক এই বিষয়ে বলেন, ‘‘জনগণ এবং গণমাধ্যমের চাপের কারণে সেলেব্রাইট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷’’