1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে তিনি ছিলেন-আছেন-থাকবেন

মোস্তফা মামুন
২৭ নভেম্বর ২০২০

একটা সময় এই দিনটার কথা খুব ভাবতাম৷ ম্যারাডোনা মারা গেলে কী হবে! মিডিয়ায় যারা কাজ করে তারা সবসময় ঝুঁকিতে থাকা তারকাদের বিষয়ে সতর্ক থাকে৷

https://p.dw.com/p/3lvKD
ডিয়েগো ম্যারাডোনা
ডিয়েগো ম্যারাডোনাছবি: Martin Rickett/PA/picture alliance

ম্যারাডোনা বয়সের হিসাবে না হলেও চরিত্রের হিসাবে সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ৷ মদ-মাদক-অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারে ঘটনা ঘটতে পারত যে-কোনো সময়ই৷ কিন্তু এসবের জন্য নয়; খুব ঝুঁকিমুক্ত মানুষও মারা যেতে পারে যে-কোনো সময়৷ ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে এই কৌতূহলের কারণ ছিল, জীবনে যেমন পৃথিবীকে একাকার করেছিলেন মৃত্যুতেও কি পারবেন? সন্দেহ হত৷ পৃথিবী বদলে গেছে৷ যত কীর্তিমানই হোন, হেলে যাওয়া সূর্য তিনি৷ উত্তাপটা পরের প্রজন্ম ঠিক টেরও পায়নি৷ আর তারুণ্যের আবেগ বাদ দিলে আজকের পৃথিবীতে কিছুই জমজমাট হয় না৷ আশ্চর্য ব্যপার, সব সমীকরণ তুচ্ছ করে ভালোবাসার চূড়ান্ত বৈশ্বিক প্রকাশ৷ কীভাবে? ঐ যে প্রবীণরাও সব তরুণ হয়ে যাচ্ছেন৷ যুবকরাও সব শৈশবে ফিরে যাচ্ছেন৷ জীবনে যেমন, মৃত্যুতেও তেমন৷ তিনিই একাকার করতে পারেন এই পৃথিবীকে৷ পৃথিবীকে তিনি এক করেন৷ আর বাংলাদেশকে নাচান-হাসান-কাঁদান৷ সবক্ষেত্র মিলিয়েও যদি বিচারটা এরকম হয় যে, কোন বিদেশি বাংলাদেশের সমাজ জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন, তাহলে উত্তর বোধহয় ওটাই৷ ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা৷ বাংলাদেশের সমাজে কীভাবে স্থায়ী হয়ে গেলেন সেই বিশ্লেষণে আসছি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই৷

১৯৮২ বিশ্বকাপ৷ উদ্বোধনী ম্যাচ বেলজিয়ামের সঙ্গে৷ মোটাসোটা ধরণের একজন খেলোয়াড় বল পেলেই ভাষ্যকাররা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠছেন৷ কিন্তু কাজের কাজ খুব কিছু হচ্ছে না৷ ধরামাত্রই দুই-তিনজন তাঁকে ফেলে দিচ্ছে৷ মানে সবাই একে চেনে৷ জানে যে এ-ই সবচেয়ে বড় বিপদ৷ তখন গুগল ছিল না৷ একটু খোঁজখবর করে জানলাম, ম্যারাডোনা নামের এই তরুণটিই আজকের পৃথিবীর সেরা ফুটবলার৷ শোনা সেই শ্রেষ্ঠত্ব চোখে দেখার জন্য চার বছরের অপেক্ষা৷ আর সেই অপেক্ষার যে কী মিষ্টি ফল৷ বিশ্বকাপ ফুটবল অনেকে খেলেছে, এর চেয়েও বেশি জিতেছে কেউ কেউ, কিন্তু এভাবে কেউ জিতেনি৷ দেখে মনে হতো, তিনি ১১ এর ১ নন, একাই ১১৷

মোস্তফা মামুন, ক্রীড়া সাংবাদিক
মোস্তফা মামুন, ক্রীড়া সাংবাদিকছবি: MIRFARID

ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচের আগে যুদ্ধের আবহ৷ ফকল্যান্ড যুদ্ধের পটভূমিতে সেই ম্যাচে যা যা করলেন এত বছর পরও দেখতে গিয়ে কেমন যেন অবাস্তব মনে হয়৷ মনে হয় এ পৃথিবীর দৃশ্য নয়৷ উরুগুয়ের কিংবদন্তি ভাষ্যকার হুগো মোরালেস সেই ম্যাচে একটা রেডিওতে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন৷ যাদুকরী দ্বিতীয় গোলটা দেখতে দেখতে স্প্যানিশ ভাষায় যা বলেছিলেন তা মহাকাব্যের মর্যাদা পেয়ে গেছে৷ ‘হুইচ প্ল্যানেট ইউ কাম ফ্রম' ইংরেজি অনুবাদে দাঁড়ানো এই কথাটি লাতিন সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম উপমা৷ কিন্তু অনেকের ম্যারাডোনা প্রেমের চূড়ান্ত রূপটা এই বিশ্বকাপেও তৈরি হয়নি৷ হয়েছিল পরের বিশ্বকাপ, ১৯৯০তে৷ তখনকার স্বাভাবিক ফুটবল সমর্থনের ধারা মেনে বেশিরভাগ মানুষ ব্রাজিলের সমর্থক৷ আর ম্যারাডোনা প্রিয় খেলোয়াড়৷ সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই দল মুখোমুখি৷ এখন! খেলার দিন পর্যন্ত দ্বিধা-সন্দেহ৷ ঠিক শুরুর বাঁশির আগে, যখন জাতীয় সংগীত বাজছে, তখন ক্লোজ আপে ম্যারাডোনার মুখ৷ সেই একটা মুহূর্তই পরের গতিপথটা বদলে দিল৷ এক পক্ষের মনে হলো, আজ যদি আর্জেন্টিনা হেরে যায় তাহলে ম্যারাডোনার খেলা আর দেখা হবে না৷ সব ভুলে এরা আর্জেন্টিনার সমর্থক৷ টিম গেমে, একজন খেলোয়াড়ের জন্য সমর্থন বদলানো তো খেলার ব্যাকরণ অনুযায়ী অন্যায় রীতিমতো৷ কিন্তু অন্যায় যদি একসঙ্গে অনেক মানুষ করে তখন এটাকে দেখা হয় অন্যভাবে৷ সেই সময় এত মানুষ এই অন্যায়টা করেছিল বলেই বাংলাদেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত৷ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী৷ মেসি-রোনালদো থেকে পরের যত বিভক্তি রেখা এসবই ম্যারাডোনাজাত৷ নিশ্চিত করে বলতে পারি, ম্যারাডোনা না আসলে আজও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এদেশে ভাই-ভাই থাকে৷

সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপেই টেলিভিশন এদেশে ব্যাপকভাবে এসেছে, আসতেই এমন বিস্ফোরণ! সব মিলে গিয়ে সেই যে আমাদের হৃদয়ে ঢুকলেন এরপর তাঁকে ঘিরেই যত কাটাকুটি৷ বিপক্ষ ছিল৷ আজও আছে৷ পরিচিত এক বন্ধু এমন ম্যারাডোনাবিরোধী ছিল যে বলত, ‘আরে কিসের কী! আমাদের চুন্নু অনেক ভালো খেলে৷ সব মিডিয়ার বাড়াবাড়ি৷' এই যুক্তি দিয়ে দিয়ে পারা যাচ্ছিল না বলে তার অন্য লাইন, ‘দেখ, দেখ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ভ্যাংচাচ্ছে৷' এমন মানুষও কম নেই৷ শুদ্ধবাদীরা মাদক-নেশা এসবে দোষ ধরবেন স্বাভাবিক৷ কিন্তু আবার এই প্রবল বিরোধিতাও আরও বেশি করে তাঁর থেকে যাওয়া নিশ্চিত করেছে৷ বিরোধীরা দোষ ধরার জন্য হলেও তাঁকে অনুসরণ করতেন৷ ম্যারাডোনা তাই সবখানে আছেন৷  সমর্থকের উত্তুঙ্গু ভালোবাসায়৷ বিরোধীর খুত ধরার তীব্রতায়৷

পুরনো সময়ে দ্বৈরথ ছিল৷ মুখোমুখি দুজনের লড়াই৷ কুস্তি কিংবা পিস্তলের লড়াইয়ে মীমাংসা৷ সময় বদলেছে বটে, আবার ঠিক বদলায়ওনি৷ আজও লড়াইয়ে বহুমাত্রিকতার চেয়ে দ্বিমাত্রিকতাই বেশি উত্তেজনার৷ রাজনীতিতে যেমন, সমাজেও তেমন৷ বাংলাদেশ ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং এক ক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিকতায় আরও বেশি আবিষ্ট৷ আর তাই এর আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল খুব উপভোগ করলেও ঠিক পক্ষ-বিপক্ষ ছিল না চায়ের কাপে ঝড় ওঠানো যেত না৷ এবার ম্যারাডোনা ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ হয়ে সেই সুযোগ করে দিলেন৷ বিভক্তিকামী সমাজ আওয়ামী লীগ-বিএনপি, আবাহনী-মোহামেডান, ভারত-পাকিস্তানের মতো আরেকবার দুই ভাগ হওয়ার সুযোগ পেল এবং কাজেও লাগাল৷ আর তাতে উত্তরোত্তর উত্তেজনার রং লেগে এমন অবস্থা যে সতীর্থদের কেউ কেউ মনে করেন, যদি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কোনোদিন বিশ্বকাপে সত্যি সত্যি মুখোমুখি হয় তাহলে খুনোখুনি হয়ে যাবে৷ আবাহনী-মোহামেডান সময়ে মান হারিয়েছে৷ বাংলাদেশ ক্রিকেটে অভিজাতদের দলে ঢুকে যাওয়ায় এই প্রজন্মের কাছে আর ভারত-পাকিস্তানের আবেদন নেই৷ আর এভাবেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আরও বড়৷ এবং এই সূত্রে কিছু উপ-শাখাও তৈরি হয়ে গেছে৷ মেসি আর্জেন্টিনার বলে সিংহভাগ আর্জেন্টিনা সমর্থক এখন বার্সেলোনার৷ অতএব জবাব দিতে ব্রাজিল সমর্থকদের রিয়ালের পাশে দাঁড়াতে হয়৷ আবার মেসিকে ম্লান করতে পারে রোনালদো৷ কাজেই রোনালদোর ভক্ত হও৷

আর এইসব ভেদাভেদকে গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে মেসি-রোনালদো, বার্সা-রিয়াল সব ফিকে হয়ে যায়৷ সূত্রধর যে তিনি৷ ম্যারাডোনার জন্যই বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, তাঁর সম্প্রসারিত সমীকরণেই মেসি-রোনালদো বা নেইমারে এই হানাহানি৷ এতটাই যে, মেসি-নেইমার বন্ধু হলেও বাংলাদেশ সেই বন্ধুত্ব মানতে নারাজ৷ দেখে দেখে একেকসময় বাংলাদেশের ক্রীড়া মননে ম্যারাডোনার যে বিস্তার তা বোধহয় আর্জেন্টিনার চেয়েও তীব্র৷

মনে আছে, ম্যারাডোনার উত্তুঙ্গু সময়ে এক অন্তপ্রাণ ব্রাজিল সমর্থক বড় ভাই বলতেন, ‘ম্যারাডোনা যাক, তারপর দেখব৷ তখন তো বাতি জ্বালিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷' সত্যি বললে, সেই সময়টা এমন ছিল ম্যারাডোনা এদিকে দুনিয়া মাতাচ্ছেন, ওদিকে ঠিক তাঁর তুল্য কেউ ব্রাজিলের নেই৷ ম্যারাডোনা গেলেন৷ রোনালদোদের যুগ শুরু হয়ে গেল৷ রোনালদো-রোনালদিনহো-রিভালদো মিলিয়ে পরের দুই দশক ব্রাজিল একচ্ছত্র৷ কিন্তু সেই মানুষটি তবু খুশি নন৷ বলেন, ‘তবু দেখো মিডিয়া ওর (ম্যারাডোনার) পেছনে ঘোরে৷ যা বলে তাই নিয়েই লাফালাফি৷ ভাবা যায়, সাংবাদিকদের গুলি করেছে, তবু মিডিয়া ওকে বয়কট করছে না৷' তাঁর মতে, মিডিয়ার ম্যারাডোনাকে বয়কট করে ওর খবর প্রচার নিষিদ্ধ করা উচিত৷ সেই মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগ নেই৷ থাকলে জানতে চাইতাম, আচ্ছা আর তো ম্যারাডোনা খবর হবেন না৷ এবার নিশ্চয়ই শান্তির দিন!

না, মনে হয়৷ শান্তি কোথায়? মৃত্যুর পর যে হাহাকার গোটা দুনিয়ার সেটা তো ওর ঘুমন্ত বড়ত্বকে আরও একবার প্রতিষ্ঠা করে দেয়৷ কিন্তু ম্যারাডোনাবিরোধী মানুষদের কাছে পরশুর পর সেটা কোনো দুঃখ নয়৷ দুঃখ তাদেরও ওটাই৷ ম্যারাডোনা আর নেই৷ চেনা বহু ব্রাজিল সমর্থককে দেখেছি, চরম বিষাদগ্রস্থ৷ বিরোধী হলেও আগে তো তাঁরা ফুটবল প্রেমী৷ আর জানেন যে, এই মানুষটার কাছে ফুটবলের  অনেক ঋণ৷ ম্যারাডোনা কি মৃত্যুতে তাঁর সূত্রে তৈরি বাংলাদেশের বিভাজনকে দূর করে দিলেন৷ হোক না সাময়িক, তবু এই বিভেদ রেখা যে কিছুক্ষণের জন্য অস্পষ্ট থাকল সে-ও একজনের পক্ষেই সম্ভব ছিল৷ ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা৷

৩৬ বছর আগে মোটাসোটা, পাশের বাড়ির চেহারাসুলভ যুবকটির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেমের শুরু৷ সেই প্রেমে সব ছিল৷ উত্তেজনা, কান্না, স্বপ্ন, বঞ্চনাবোধ৷ শেষ হলো শেষে, ২৫ নভেম্বর, বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাতে৷

না, শেষ বোধহয় নয়৷ জীবনে এই প্রেম চিরস্থায়ী ছিল৷ আর যে প্রেম জীবনে স্থায়ী থাকে মৃত্যুর কী সাধ্য, একে শেষ করে৷ অতএব পৃথিবীর অন্য জায়গায় কী হবে না হবে জানি না৷ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটাই সত্য৷ ছিলেন, আছেন, থাকবেন৷