বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের চিত্র
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি সবচেয়ে শোচনীয়৷ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার ২০ টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে৷ আরো জানুন ছবিঘরে...
খেলাপি ঋণ কী
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহক তার ঋণ বা এর উপর আরোপিত সুদ পরিশোধ না করলে তা খেলাপি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়৷ বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে৷ ছয় থেকে ১৮ মাসের বকেয়া ঋণকে নিম্নমানের, ১৮ থেকে ৩০ মাসের বকেয়াকে সন্দেহজনক এবং তার বেশি সময় পরিশোধ না হলে তা অনাদায়ের ঝুঁকিতে থাকা মন্দ ঋণ৷
আট শতাংশ
আইএমএফ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত মেনে আগস্টে প্রকাশিত বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে গত বছরের খেলাপি ঋণের বিশদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ সেই হিসাবে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের আট শতাংশের বেশি৷ সবশেষ মার্চের হিসাবে তা বেড়ে আট দশমিক আট শতাংশ হয়েছে৷
প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি
বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, এই পরিসংখ্যানেও খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না, কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায়ই নানা সুবিধা দিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে৷ সেগুলো তখন আর খেলাপির তালিকায় রাখা হয় না৷ ২০২২ সালে এমন বকেয়া পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা৷ আর বকেয়া খেলাপি ঋণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।
দেশের বাজেটের অর্ধেক
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা৷ অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের অর্ধেকের সমপরিমাণ৷
৮৮ শতাংশই মন্দ ঋণ
মোট খেলাপি হওয়া ঋণের সাড়ে ৮৮ শতাংশই আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে অনাদায়ী৷ অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো গ্রাহককে তাগাদা দিয়েও সেগুলো আদায় করতে পারছে না বা পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের শ্রেণি অনুযায়ী, যা মন্দ বা না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ঋণ৷
পাঁচ ব্যাংকেরই অর্ধেক
বাংলাদেশে এখন মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি৷ এর মধ্য মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৬ শতাংশ ৫টি ব্যাংকের গ্রাহক৷ আর প্রথম দশটি ব্যাংকের প্রায় ৬৫ শতাংশ৷ আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের বেশি৷ এর তিনটি সরকারি, তিনটি বেসরকারি, একটি বিদেশি আর একটি বিশেষায়িত৷ ৩৮টি ব্যাংকের খেলাপির হার পাঁচ শতাংশের কম৷
সরকারি ব্যাংকে ২০%
সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার অন্তত ২০ টাকাই খেলাপি৷ বিশেষায়িত ব্যাংকে এটি প্রায় ১৩ শতাংশ৷ অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকে এই হার পাঁচ শতাংশের কিছু বেশি৷ তবে বেসরকারি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ বেশি হওয়ায় তাদের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ সরকারি ব্যাংকেরই সমান৷ খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে কম বিদেশি ব্যাংকগুলোর যা পাঁচ শতাংশেরও কিছু কম৷
সরকারিতে বাড়ছে, বেসরকারিতে কমছে
গত এক বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ এক শতাংশ বেড়েছে৷ কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে উল্টো দশমিক এক-আট শতাংশ কমেছে৷
সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক
খেলাপি ঋণে সবচেয়ে এগিয়ে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ মোট খেলাপির প্রায় ২৭ শতাংশ আছে তাদের কাছে৷ সব মিলিয়ে খেলাপির ৫৫ ভাগই শিল্প খাতের৷
ফিরে দেখা
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশে পৌঁছায়৷ সত্তর ও আশির দশকে ব্যাংকগুলো যাথযথ নিয়ম মেনে ঋণ প্রদান না করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে৷ তবে নজরদারি বৃদ্ধির কারণে ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১১ সালের দিকে খেলাপি ঋণের হার ৬.১ শতাংশে নামে৷ কিন্তু পরের বছর তা দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়৷
অন্যান্য দেশ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি৷ বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় ভারতে এই হার সাড়ে ছয় শতাংশ, পাকিস্তানে সাত দশমিক তিন, নেপালে দুই দশমিক চার, শ্রীলংকায় প্রায় পাঁচ, মালদ্বীপে প্রায় ছয় শতাংশ৷ যেখানে বাংলাদেশ খেলাপি ঋণের হার আট শতাংশের বেশি৷