‘ক্ষমতাসীনরা সংবাদমাধ্যমকে সব সময় শত্রু মনে করেছে’
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে কি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যথেষ্ট হচ্ছে? আপনি নিজেও তো একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছিলেন৷ সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলবেন?
মুস্তাফিজ শফি : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদনের প্রথম উদাহরণ দৈনিক ইত্তেফাকে আবেদ খানের ‘ওপেন সিক্রেট’৷ ওপেন সিক্রেট ছিল মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর সরেজমিন প্রতিবেদন৷ সেটাকে যদি আমাদের প্রথম ভিত্তি ধরি, তাহলে আমি বলবো যে, আমাদের দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেক এগিয়েছে৷
আপনি আমার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কথা বলেছেন৷ আমাদের শুরুর সময়টায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগটা বেশি ছিল না৷ আমাদের প্রথমত, সেরকম প্রশিক্ষক ছিল না৷ লেখাপড়া করার খুব বেশি সুযোগ ছিল না৷ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নামে একটি বিভাগ ছিল৷ বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না৷ আমি নিজে সাংবাদিকতায় পড়িনি, বাংলায় পড়েছি৷ আমি কাজ করতে করতে একেবারে মফস্বল থেকে শুরু করে, সাংবাদিকতার প্রতিটি স্তর পেরিয়ে এখন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি৷
আগে যে সুযোগের অভাব ছিল, এখন কিন্তু সেরকম না৷ এখন সবাই জেনে-বুঝে সাংবাদিকতায় আসছেন৷ তারা জানেন, অনুসন্ধান কীভাবে করতে হয়৷ সমস্যা অন্য জায়গায়৷ শুধু সাংবাদিকতায় নয়, সবক্ষেত্রেই শর্টকাট করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ এই শর্টকাটে জনপ্রিয়তা অর্জন, অতিক্রম করার প্রবণতা, সেই প্রবণতা কিন্তু সাংবাদিকতাকেও পেয়ে বসেছে৷
বিশ্বের সাথে তুলনা করলে আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কতটা এগিয়েছে?
শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবেও এই শর্টকাট প্রবণতা আছে৷ আমরা যদি পুলিৎজার পুরস্কারগুলো পর্যালোচনা করি, সেখানেও যে পুরস্কারগুলো পাচ্ছে, সেই বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একেবারে পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না৷ এখানকারও অনেক প্রতিবেদন বৈশ্বিক যে বিভিন্ন সংস্থা আছে, সেখানে বিবেচনার মধ্যে গিয়েছে৷ সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলো'র একটি প্রতিবেদন, যেটা রোজিনা ইসলাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের যে পদক দেয়া হয়েছে, সেখানে জালিয়াতি হয়েছে- এই রিপোর্টটিকে কিন্তু আমি একেবারে বিশ্বমানের রিপোর্ট বলবো৷
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়৷ তা কি বেড়েছে? আইন কি সহায়ক?
আমি এক বাক্যে সহায়ক বলবো না৷ আইনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে৷ ২০১৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে৷ এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একদিকে আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷ আবার অন্যদিকে আমি বলবো, এই আইনটির কারণে আমরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়েছি৷ আরো সতর্ক হয়েছি৷ ফলে এই আইনটির পরও যারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছেন, তারা সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা আরো বেশি পালন করে এগিয়ে যাচ্ছেন৷
বাংলাদেশে কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঝুঁকি বেশি?
বেশি আমি বলবো না৷ ঝুঁকি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সব সময়ই ছিল৷ ভবিষ্যতেও যে থাকবেনা তা আমি বলবো না৷ বৈশ্বিক যে ঝুঁকি সেই তুলনায় বাংলাদেশে ঝুঁকি কম বলে আমি মনে করি৷ কারণ, বাংলাদেশে তো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা করতে হচ্ছে না৷
এর বাইরে আর কোনো ঝুঁকি এখানে আছে কিনা...
আমি আইনের বিষয়টি আবারও বলতে চাই৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিন্তু আমরা বিরোধী নই, আইনটির প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু সম্পাদক পরিষদের যে স্ট্যান্ড, এই আইনের কিছু নিবর্তনমূলক ধারা আছে৷ সেগুলোতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা মনে করেছি৷ সেই মনে করাকে এখনো আমি মনে করি সঠিক৷ ওই ধারাগুলোকে বাতিল ও সংশোধন করে সাংবাদিকতা সহায়ক করা উচিত৷ আরেকটি ঝুঁকি আছে৷ বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে এখন বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ বিনিয়োগ করেছে৷ তাদের পত্রিকায় সাংবাদিকদের বিছুটা হলেও সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়৷
প্রতিষ্ঠানগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আগ্রহী? তারা কি বিনিয়োগ করে?
আগ্রহ নাই সেটা নয়৷ কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের তো সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ এটা শুধু আমার পত্রিকার কথা বলছি না ৷ আমি এখনকার পরিবেশের কথা বলছি৷ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও এখন পত্রিকার মালিক৷ অনেক এমপি আছেন পত্রিকার মালিক৷ ফলে তার দলের সুবিধা-অসুবিধা তাকে দেখতে হয়৷ তার দলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট হলে তিনি তার পত্রিকার সাংবাদিকদের সেটা দিতে নিরুৎসাহিত করেন৷
সংবাদমাধ্যমের ভেতরেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শক্তি রয়েছে বলে মনে হয়?
সেটা আমার পত্রিকায় নেই৷ অন্য কারো আছে কিনা আমি বলতে পারবো না৷ কিন্তু আমি যখন চিন্তা করি, তখন আমার পত্রিকায় যারা বিনিয়োগ করছেন, তাদের স্বার্থটাকে আমার মাথার মধ্যে নিই৷ কিন্তু এখানে একটি উদাহরণ দিতে চাই, ওয়ান ইলেভেনের সময়, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও কিন্তু ‘সমকাল' রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলেছে৷
এমন কী ঘটেছে যে রাষ্ট্রীয় শক্তি কখনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপতে বাধা দিয়েছে বা ছাপতে দেয়নি বা অনুসন্ধান শুরুই করা যায়নি? আপনার অভিজ্ঞতা কী?
আমরা অনেক সময় পার করে এসেছি৷ আমরা স্বৈরশাসনের সময়ে ছিলাম৷ আমি ৯০-এর আগের কথা বলছি৷ সেই সময়ে সাংবাদিকতা কেমন ছিল তা আমরা সিনিয়রদের কাছ থেকে জানি৷ তার পরবর্তী যে সময়টি, তার অবস্থা আমি বলবো, ওই সময়ের চেয়ে ভালো৷ তারপরে সেনা সমর্থিত সরকার পার হয়ে আমরা এখন গণতান্ত্রিক সরকারে বাস করছি৷ আমি জোর দিয়ে বলছি, যারা পত্রিকার মালিক তারা ব্যবসা করবেন, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করেন, তাহলে স্বাধীন সাংবাদিকতা বিঘ্নিত হয়৷
কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার মতো প্রতিবেদন করে না বা করতে সাহস করে না...
আমি ওইভাবে তুলনা করতে চাই না৷ আল-জাজিরার যে বিষয়টি বলছে ওটা তো বিতির্কিত একটি বিষয়৷ প্রতিবেদনটির গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও কিন্তু অনেক বিতর্ক আছে৷ বলা হচ্ছে, দুই বছর ধরে অনুসন্ধান করা হয়েছে৷ কিন্তু দেখবেন অনেক গ্যাপ৷ দুই বছর অনুসন্ধানে, একটি প্রোপাগান্ডা তো দুই বছরের অনুসন্ধানী রিপোর্ট হিসেবে প্রচার হতে পারে না৷
সাংবাদিক, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য কোনো সুরক্ষা আইন বা রাষ্ট্রের কোনো সহায়তার দরকার আছে কি না?
আমাকে কেউ আলাদাভাবে সুরক্ষা দেবে এটা আমি মনে করি না৷ আমি মনে করি, আমার বিরুদ্ধে যে আইনগুলো আছে, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে নিবর্তনমূলক ধারাগুলো আছে, সেগুলো যদি বাতিল হয়, তাহলে আমার সুরক্ষা আমি নিতে পারবো৷ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের অনেক আইন আছে৷ প্রেস কাউন্সিল আইন আছে, ফৌজদারি আইন আছে৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিককে কেন অন্তর্ভূক্ত করতে হবে? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো নিবর্তনমূলক আইন থাকবে না, সেটাই আমার সুরক্ষা৷ এই সুরক্ষা আমি চাই রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে৷
বর্তমান সরকার কি সাংবাদিকতার কোনোভাবে গলা চেপে ধরছে বা অনুসন্ধানী সাংদিকতাকে নানা কৌশলে আটকে দিচ্ছে?
আমি ঠিক এটাকে এইভাবে দেখতে চাই না৷ সবসময়ই ক্ষমতাসীনরা কিন্তু সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যমে শত্রু মনে করেছে৷ সেটা জাতীয় পার্টি বলেন, স্বৈরশাসন যখন ছিল তখন বলেন বা পরবর্তীতে বিএনপি সরকার এসেছিল, আওয়ামী লীগ সরকার এসেছিল, আবার বিএনপি, এখন আবার আওয়ামী লীগ সরকার৷ সবার এই জায়গায় মানসিকতা কিন্তু প্রায় কাছাকাছি৷ তারা মনে করেন যে, তাদের কোনো মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে রিপোর্ট গেলে বোধহয় তাদের পুরো দলের বিরুদ্ধে রিপোর্টটি চলে গেছে, পুরো সরকারের বিরুদ্ধে রিপোর্টটি চলে গেছে৷ এটা আমাদের রাজনীতির একটি প্রবণতা৷ এটা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, শুধু বিএনপির নয়, সবার৷
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন প্রয়োজন? দেশের মানুষ, রাষ্ট্র, সরকারকে কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কোনো সহায়তা করতে পারে?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়৷ কেন বলা হয়? আসলে এই গণমাধ্যমই চোখ খুলে দিতে পারে সব কিছুর৷ সেই জায়গায় কেউ যখন সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত হন, তখন মনে করেন, এটা বোধ হয় তার সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তার দলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে৷ কিন্তু ভুল সংশোধন করার জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দরকার৷ আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন না যে কী হচ্ছে, সেই জায়গাটিতে সংবাদপত্র ধরিয়ে দেবে আপনাকে৷ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে স্বাধীন সাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা খুবই জরুরি বিষয়৷ এটা যদি কেউ ব্যাহত করার চেষ্টা করেন, তিনি বুঝে হোক আর না বুঝে হোক তিনি গণতন্ত্রেরই ক্ষতি করছেন৷
২০১৬ সালের ছবিঘরটি দেখুন...