1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের হিসাব নিকাশ

১১ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে থাকা প্রভাবশালী প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে একটা আবেগের সম্পর্ক রয়েছে আমাদের৷ কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব আবেগই একসময় ফিকে হয়ে আসে, বাস্তবতার নিরিখে শুরু হয় হিসেব নিকেশ৷

https://p.dw.com/p/3R7k9
প্রতীকী ছবিছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta

আর সেজন্যই হয়তো ‘‘ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের সব পানি নিয়ে গেছে ভারত'', শৈশব থেকে এমন কথা শুনে শুনেই বড় হয়েছি আমরা৷ প্রতিবেশি যদি ভালই হয়, তবে সে আমাদের কষ্টে রেখে সব পানি নিয়ে যাবে কেনো? একবারো ভাববে না, অন্য প্রতিবেশির ভাল-মন্দ? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই মনের মধ্যে জেগেছে সে সময়৷

পরে ১৯৯৬ সালে আমরা যখন তারুণ্যে তখন দুই দেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির একটা চুক্তি হয়, যাতে বাংলাদেশের শুকিয়ে যাওয়া পদ্মা তার প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহ ফিরে পাবে বলে জানতে পারি আমরা৷ সেও তো ২৩ বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু বাস্তবে শীর্ণ পদ্মা আর আগের মত প্রমত্তা হলো কই? সরকারি লোকজনই মাপ-জোখ করে বলছেন, ‘‘চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ৷'' 

৩০ বছরের গঙ্গা চুক্তি বহাল থাকবে আরো সাত বছর, বাকি দিনগুলিতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পানি পাওয়া যাবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়৷ প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়নের মধ্যে এই সমন্বয়হীনতার দাম দিতে হচ্ছে পদ্মা পাড়ের সাধারণ মানুষকে৷ তাদের জীবন-জীবিকা বদলে গেছে, নদীর মতই শুকিয়ে গেছে প্রাণ প্রবাহ৷

পানি নিয়ে বাংলাদেশের আরো এক দুশ্চিন্তার নাম তিস্তা, ভারতের জলপাইগুড়িতে ব্যারাজ বানিয়ে অপরিমিতভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় কমে গেছে বাংলাদেশের তিস্তার পানি প্রবাহ৷ সেখানে এখন পলি পড়ে জেগেছে বিস্তীর্ণ চর, বেড়েছে নদী তীরের মানুষের হাহাকার৷ বর্ষাকালে এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান দুঃখ উজান থেকে ছেড়ে দেয়া তিস্তার পানি, আবার শুকনা মৌসুমেও তাদের দুঃখের নাম একটিই- তিস্তা, তবে সেটি পানিহীন তিস্তা৷ বেশ কয়েকবার এই বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশের আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সবাই জানেন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনীহায় এখনো তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে কোন চুক্তি করা সম্ভব হয়নি৷

এরই মধ্যে ভারতের ত্রিপুরার মানুষের খাবার পানির সংকট মেটাতে আমাদের ফেনি নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি নিতে ভারতকে অনুমতি দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং বলেছেন, ‘‘কেউ যদি পানি পান করতে চায়, আর তা যদি না দিই কেমন দেখায়?'' প্রতিবেশীর প্রতি বাংলাদেশের এই মহানুভবতা নিঃসন্দেহে প্রচলিত দেনা-পাওনার হিসেবের উর্ধ্বে৷ কঠোর বাস্তববাদিরা হয়তো বলবেন, ‘গিভ এন্ড টেক'-এর এই দুনিয়ায় বাংলাদেশ ভারতকে দেয়ার ক্ষেত্রে যতটা উদার নেয়ার ক্ষেত্রে ততটা পারদর্শী নয়৷

অনেকেই বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ ভারতের স্বার্থকে যতটা প্রাধান্য দিচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের স্বার্থকে ততখানি মূল্যায়ন করেনি৷ অথচ যে কোন সম্পর্ক টেকসই হতে হলে, দুই পক্ষই নিজেদের ‘উইন-উইন' অবস্থানে ভাবতে পারাটা জরুরী৷

কিছুদিন আগে এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘‘ভারত আমাদের পাশে না থাকলে স্বাধীনতা যুদ্ধ যেভাবে শেষ হয়েছে সেভাবে হতো না, কিন্তু কথা হলো, তার পরিবর্তে আজকে বাংলাদেশকে নিজেদের বাজারের জায়গা বানিয়েছে ভারত৷'' 

এটা ঠিক, দুইদেশের মধ্যে স্থল ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে৷ তবুও অর্থনীতিবিদরা বরাবরই কথা বলেন, বাংলাদেশ ভারতের অব্যাহত বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে৷ যদিও গত অর্থবছরে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানির পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, আর সেটা হয়েছে মূলত তৈরি পোষাক রফতানি থেকে৷ অর্থনীতিবিদদের মতে, শুধু এরকম একটা দুটো পণ্য নিয়ে বাণিজ্যে বাংলাদেশ হয়তো ভারতের বাজারে তেমন সুবিধা করতে পারবে না৷ কারণ এখনো আমরা রপ্তানির চাইতে ভারত থেকে আটগুণ বেশি আমদানি করি৷ বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৭৭৫ কোটি ডলার৷ অনেকেই মনে করেন, বিনিয়োগ সুবিধা ও সেবা বিক্রির ব্যাপারে বাংলাদেশ ভারতের সাথে দেন দরবার করে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে৷

তবে বাণিজ্যের চাইতে অভিন্ন নদীগুলির পানি প্রবাহ সচল রাখার ক্ষেত্রে দ্রুত সমঝোতায় আসাটাই দুই দেশের দেনা-পাওনার সম্পর্কটা শক্ত করতে সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন তারা৷ দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রাণবন্ত রাখতে হলে অর্থনৈতিক জায়গার পাশাপাশি পানি বণ্টনের বিষয়টির সুস্পষ্ট সুরাহা হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত তাদের৷

বাংলাদেশের আরেক গলার কাঁটা রোহিঙ্গা সংকট৷ এই সংকট সমাধানে বড় লোক প্রতিবেশি ভারতের কোনো আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, বরং আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ যেমন আশা করেছিল তেমন জোরালো কোন ভূমিকাই রাখেনি ভারত৷ উল্টো, এ বছরের শুরুর দিকে ভারত তাদের দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে সংকট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় সামাজিক সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিকে যতটা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, অর্থনৈতিক ও পরিবশগত বিষয়গুলিকে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি৷ অথচ কৌশলগতভাবে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের বিষয়টিতে জোর দেয়াই আমাদের জন্য বেশি জরুরি ছিল৷ জরুরি ছিল নদীর পানি, রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে ভারতের জোরালো প্রতিশ্রুতি আদায় করা৷

ভাল সম্পর্ক কখনোই একপাক্ষিক হতে পারে না,  সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে হলে ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'- এই আপ্ত বাক্যের চর্চা ও প্রয়োগ করতে হয়৷ এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দরকষাকষিতে পিছিয়ে পড়লে চলবে না৷ ভারত যেভাবে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ দেখে চলছে, বাংলাদেশকেও সেভাবেই নিজের স্বার্থ বুঝে নিতে হবে৷

Shahnaz Munni
শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিকছবি: privat

কিছুদিন আগে, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে মজাদার মন্তব্যটি করেছিলেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন৷ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের একটা বাংলা দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো, টুকটাক মতানৈক্য থাকলেও তা মিটে যায়৷''

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই রসালো মন্তব্য সমমর্যাদার স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও হতে পারে, কিন্তু ভারত যদি নিপীড়ক স্বার্থপর স্বামীর ভূমিকায় থাকে আর বাংলাদেশ থাকে নতজানু অনুগত স্ত্রীর ভূমিকায়, তাহলে সেই সম্পর্ক হবে অসম এবং ঠুনকো৷ এতে মতানৈক্য বাড়বে, তিক্ততাও বাড়বে৷

বাংলাদেশের জনমানুষের মনে একটু একটু করে ভারতের কর্তৃত্ববাদি, সুবিধাবাদি বড় ভাই সুলভ যে ইমেজ গড়ে উঠেছে তার পরিবর্তন করতে হলে, ভারতের একক সিদ্ধান্তের ফলে প্রত্যক্ষভাবে গণমানুষ যেসব সমস্যা ভোগ করছে তা দূর করতে হবে৷ হিসাব নিকাষ হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে, আন্তরিকতার সঙ্গে৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷