বাংলাদেশ কি উন্নয়নের টেক্সটবুক উদাহরণ?
২৬ মার্চ ২০২১২০০৯ সালে আইরিক জি ইয়ানসেন যখন ফের বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে আসেন, রীতিমত চমকে ওঠেন৷ নরওয়ের এই সমাজ নৃতাত্ত্বিক সত্তরের দশকে এই মানিকগঞ্জেরই একটি গ্রামে কয়েক বছর থেকে গবেষণা করেন৷ এমনকি পরের প্রায় পুরোটা দশকই ছিলেন বাংলাদেশে৷ কিন্তু গ্রামের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য এতটা বদলাতে দেখেননি তিনি়৷
‘‘দিনে যা রোজগার ছিল তা দিয়ে বড় জোর এক-দেড় কেজি চাল নিয়ে বাড়িতে ফিরতেন সেই মানুষগুলো৷ বাড়িতে যদি পাঁচ, ছয়টি মুখ খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, তখন এই আয় খুবই নিতান্ত,’’ স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন আইরিক৷
১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জের একটি গ্রামে কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে রীতিমত বসবাস করেন আইরিক৷ তিনি সেই পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করছিলেন৷ আশির দশকেও এখানে গবেষণা করেছেন, দূতাবাসে চাকরি করেছেন৷
‘‘বাংলাদেশে তখন দারিদ্র্য মানে ছিল খাবারের অভাব,’’ ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে বলেন তিনি৷ ‘‘স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবা তো প্রায় অনুপস্থিত ছিল৷ আমি অনেককে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সে অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে মারা যেতে দেখেছি৷’’
আশির দশকের পরে মাঝখানে প্রায় দেড়, দুই দশক বাংলাদেশে আসেননি আইরিক৷ এরপর এলেন ২০০৯ সালে৷ ‘‘দেখলাম, তাদের আয় দশগুণ বেড়েছে৷ দৈনিক আয় দিয়ে এই মানুষগুলো এখন ১০ থেকে ১৫ কেজি চাল কিনতে পারছে,’’ বলেন তিনি৷
বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশকে দেখে আবার গবেষণা করার ইচ্ছে জাগে আইরিকের৷ তিনি সেই গ্রামে সেই পরিবারগুলোর সঙ্গে ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কাটান৷ বোঝার চেষ্টা করেন পরিবর্তনের কারণগুলো৷
‘‘বাংলাদেশের উন্নয়নের এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে আমার লেখা বই এখন নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়,’’ বলেন আইরিক৷ ‘‘উন্নয়নের খুব ইতিবাচক মডেল তো আমরা সচরাচর তেমন দেখি না৷’’
উন্নয়নের ‘দি' টেস্ট কেস
রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন তার অর্থনীতির ছিল করুণ দশা৷ সাড়ে সাত কোটি মানুষের ৮০ ভাগই ছিলেন দারিদ্রসীমার নীচে৷ অভ্যুত্থান ও পালটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলে ব্যস্ত একদল উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা৷ খুব অল্প প্রাকৃতিক সম্পদের এই ভূখণ্ডে অভাব হত না প্রাকৃতিক দুর্যোগের৷
‘‘সত্তরের দশকে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই আমি পড়েছি, যেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘এ টেস্ট কেস’ নয়, ‘দি টেস্ট কেস’,’’ বলেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সিনিয়র ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান৷ ‘‘সেখানে বলা হয়েছিল যদি বাংলাদেশে উন্নয়ন সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় উন্নয়ন সম্ভব৷’’
বাংলাদেশ এখন দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি৷ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির হিসেবে, ২০১৮ সালে দারিদ্রের হার কমে হয়েছে ২১.৮ শতাংশ এবং অতিদারিদ্রের হার ২০১৯ সালে দাঁড়ায় ৯.২ শতাংশ৷ করোনার আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রায় আট ভাগ হারে বেড়েছে অর্থনীতি৷ এমনকি করোনার আঘাতও এ বছর দ্রুত কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বাংলাদেশ৷
‘‘মাত্র প্রায় এক লাখ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারে প্রায় সাড়ে ষোল কোটি মানুষ বাস করেন৷ তাদের সবার খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করছে বাংলাদেশ,’’ বলেন মুস্তাফিজ৷ ‘‘মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় কমেছে৷ গড় আয়ু একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক, যার মধ্যে অনেকগুলো সূচক রয়েছে৷ সেখানে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ১৯৭১ সালের ৪৯ বছর থেকে বেড়ে এখন তা ৭২ বছর৷’’
দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় মানুষের গড় আয়ু বাংলাদেশের চেয়ে বেশি৷
এছাড়া ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ৷ খুব শিগগিরই জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশ৷ মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার৷ ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৯তম বড় অর্থনীতি৷
কৃষি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি
২০১০ সালে আইরিক যখন মানিকগঞ্জের সেই গ্রামে সেই পরিবারগুলোর কাছে ফেরত আসেন, তখন দেখেন সেখানকার স্কুলগুলোর আমূল সংস্কার হয়েছে৷ ছেলে মেয়ে উভয়েই এখন স্কুলে যায়৷ স্বাস্থ্যসেবার মান ভাল এবং কৃষি উৎপাদন বেড়েছে অনেক৷
‘‘এর মূল কারণ কৃষিবহির্ভূত কাজের সুযোগ,’’ ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখ্যা করেন আইরিক৷ ‘‘অনেক নারী গার্মেন্টসে চাকরি করেন কিংবা হস্তশিল্পের কাজ করেন৷ পুরুষরা স্থানীয় ছোটখাট শিল্পগুলোতে কাজ পাচ্ছেন৷ কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া যাচ্ছেন৷’’
পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে কৃষি থেকে শিল্পভিত্তিক হয়েছে৷ যেখানে ১৯৭১ সালে জিডিপির প্রায় অর্ধেক নির্ভরশীল ছিল কৃষির ওপর, সেখানে এখন কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা ১৩ ভাগ৷
‘‘ক্রমাগত নগরায়ন হচ্ছে৷ বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গ্রাম থেকে সরে এসেছে,’’ বলেন সিপিডির মুস্তাফিজুর রহমান৷ ‘‘এমনকি কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষিবহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেব করলে গ্রামীণ অর্থনীতিও বদলে যাচ্ছে৷’’
আইরিক বলেন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি বিশেষ করে নারী শিক্ষা উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে৷ ‘‘মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে কাজ হয়েছে৷ এখন মেয়েরা অনেক সপ্রতিভ৷ চার দশক আগে তারা অনেক বেশি অন্তর্মুখী ছিলেন,’’ বলেন তিনি৷
তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্র পালটে দিয়েছে বলে মনে করেন মুস্তাফিজুর রহমান৷ বিশেষ করে উৎপাদনমূলক অর্থনীতিতে রূপান্তরে বড় ভূমিকা রেখেছে৷ বাংলাদেশের ৮০ ভাগ রপ্তানি আয় আসে এই শিল্প থেকে, যা জিডিপির ১২ ভাগ৷ এছাড়া প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত, যার অধিকাংশই নারী৷
‘‘তৈরি পোশাকশিল্প শুধু অর্থনীতির চিত্রই যে পালটেছে তাই নয়, নারীর সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি করেছে,’’ বলেন মুস্তাফিজ৷
এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করছে বলে মনে করেন তিনি৷
মান ও বৈষম্য সংকট
যদিও প্রায় ৯৭ ভাগ শিশু প্রাইমারি স্কুলে যাচ্ছে, শিক্ষার মানের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷
জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ অনেক সূচকই উর্ধ্বমুখী হলেও ধনী-গরীবের বৈষম্য বাড়ছে দিন দিন৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপও তাই বলে৷
‘‘মাথাপিছু আয় বেড়েছে৷ তবে সম্পদের বন্টনে ন্যায্যতা ও সমতার অভাব দূর করা যেত,’’ বলেন অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজ৷ ‘‘সমাজের উচ্চআয়ের পাঁচ ভাগের সঙ্গে নিম্ন আয়ের ৪০ ভাগের বৈষম্য বাড়ছে প্রতিনিয়ত৷’’
তার মতে, এলাকা কেন্দ্রিক আয়বৈষম্যও দেখা যায়৷ ‘‘দারিদ্র্য হয়তো ২০ ভাগের কাছাকাছি এসেছে৷ কিন্তু এমন জেলা আছে যেখানে দারিদ্রের হার ৫০ ভাগ,’’ বলেন তিনি৷
আগামী দিনে উন্নয়ন টেকসই করতে হলে এই বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷