বাংলাদেশ ও ম্যারাডোনা, এ এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনি!
২৭ নভেম্বর ২০২০ম্যারাডোনা সর্বশেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন সেই ২৬ বছর আগে৷ তাও না খেলার মতোই৷ এমনিতেই সেরা সময় অনেক পেছনে ফেলে এসেছিলেন৷ তারপরও স্বপ্ন দেখেছিলেন যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার৷ ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে বহিস্কৃত হওয়ায় সেই বিশ্বকাপও শুরু হওয়ার আগেই শেষ৷ তারপরও ২৫ বছরের বাংলাদেশি যুবক ম্যারাডোনার মৃত্যুতে কাঁদছে কেন?
ম্যারাডোনাকে ম্যারাডোনা বানিয়েছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ৷ আমাদের বয়সী কারও মনে হতেই পারে, হয়ও, মেক্সিকো বিশ্বকাপ? এই তো সেদিনের কথা৷ আসলে তো ৩৪ বছর কেটে গেছে এরপর৷ বিতর্কিত পেনাল্টিতে বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে মাঠেই ম্যারাডোনাকে মাঠেই অঝোরে কাঁদতে দেখার স্মৃতিতেও তো ৩০ বছরের ধুলোর আস্তরণ৷ অথচ অনেক ২০-২২ বছর বয়সী তরুণের মুখে সেটির এমন প্রাঞ্জল বর্ণনা শুনি, যেন নিজেই তা দেখেছেন৷
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা এই ম্যারাডোনা প্রীতির রহস্যটা কোথায় লুকিয়ে? ইউটিউব তো অবশ্যই একটা বড় কারণ৷ যা খুলে দিয়েছে অতীতের এক আশ্চর্য দরোজা৷ একটা ঘটনার কথা শুনলাম বা কোনো নাম—ইউটিউবে সার্চ দিলেই তা হাজির হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে৷ আর খেলা ছাড়ার পরও ম্যারাডোনা এমনই এক অনন্ত খবরের উৎস হয়ে ছিলেন যে, এই নামটা প্রতিনিয়তই নেচে বেরিয়েছে চোখের সামনে৷ সেই খবর সব সময় যে প্রীতিকর হয়েছে, এমন নয়৷ ভুল কারণেই বেশি খবর হয়েছেন, আর বিতর্ক তো ছিল ছায়াসঙ্গী৷ আশ্চর্যই বলতে হবে, এ সব যেন আরও ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামটাতে আরও বেশি মাদকতা যোগ করেছে৷ আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাঁর আকর্ষণ৷
এমন বর্ণময় চরিত্র শুধু ফুটবল কেন, আর কোনো খেলার ইতিহাসেই তো খুঁজে পাওয়া কঠিন৷ কঠিন না বলে অসম্ভবও বলে দেওয়া যায় অনায়াসে৷ লার্জার দ্যান লাইফ বলতে কী বোঝায়, ম্যারাডোনার জীবন যেন তারই একটা ডকুমেন্টারি৷ ৬০ বছরের জীবনটা কাটিয়ে গেছেন একেবারে নিজের ইচ্ছামতো৷ মাঠে বল পায়ে যেমন যা ইচ্ছা করতে পারতেন, মাঠের বাইরেও উড়িয়েছেন ইচ্ছাঘুড়ি৷ পরের মুহূর্তে কী করবেন, অন্য কেউ তা অনুমান করবে কীভাবে, নিজেই কি তা জানতেন নাকি! ফুটবলার হিসাবে কত বড় ছিলেন, সেই তর্ক এত দিনে অনেকটাই মীমাংসিত৷ তবে শুধু ফুটবল মাঠের কীর্তিই বিশ্ব জুড়ে ম্যারাডোনাকে ঘিরে এমন উন্মাদনার একমাত্র কারণ নয়৷ খামখেয়ালি চরিত্রেরও তাতে বড় ভূমিকা৷
বিদ্রোহী আর প্রতিবাদী সত্ত্বারও৷ কে কী ভাববে, কে কী বলবে, তার থোড়াই তোয়াক্কা করে অকপটে নিজের মনের কথা বলে গেছেন সারা জীবন৷ তাতে ফিফা রাগ করল না যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হলো, এ সবে কখনোই তাঁর কিছু আসে যায়নি৷ বুয়েনস এইরেসের বস্তি থেকে খ্যাতির শীর্ষে উঠে আসা আর্জেন্টিনিয়ান যেন তৃতীয় বিশ্বের বঞ্চিত নিপীড়িত সব মানুষের প্রতিনিধি৷ হাতে আঁকা উল্কিতে চে গেভারা, পায়ে বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর৷ সবকিছু মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী এমন এক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল যে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা শুধুই একজন ফুটবলারের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন জনতার নায়ক৷
বাংলাদেশে বোধ হয় আরও বেশি৷ শুধু বাংলাদেশ না বলে বাঙালি বললে বোধ হয় তা আরও ঠিক হয়৷ বাংলাদেশের মতো পশ্চিম বাংলাতেও একদা ব্রাজিল অধ্যুষিত ফুটবল জনমানসে আর্জেন্টিনার ছবি এঁকে দেওয়ার কাজটা ম্যারাডোনাই করেছেন৷ লিওনেল মেসির কথা বলবেন না৷ মেসি এই সমর্থন ভোগ করছেন উত্তরাধিকার সূত্রেই৷ খ্রীস্টপূর্ব আর খ্রীস্ট পরবর্তী সময়ের মতো বাঙালির ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় ভাগ হয়ে যাওয়ারও পরিষ্কার একটা বিভাজনরেখা আছে৷ ম্যারাডোনার কীর্তিধন্য সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপ৷ আট বছর আগে আর্জেন্টিনা প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছে৷ আর্জেন্টিনিয়ানদের সেই আনন্দে এই ভূখন্ডের কেউ শরিক হয়ে ছিল বলে জানা যায় না৷ আমজনতার অনেকে হয়তো প্রথম শুনেছিল এই দেশটির নাম৷
ম্যারাডোনার আবির্ভাব ঘোষণা করা ১৯৮২ বিশ্বকাপেও সক্রেটিস-জিকো-ফ্যালকাওদের ব্রাজিলেই মজে ছিল বাংলাদেশ৷ পরের বিশ্বকাপেই যেটি ভোজবাজির মতো বদলে গেল৷ ম্যারাডোনার অতিমানবীয় পারফরম্যান্স তো অবশ্যই বড় কারণ৷ তবে আরও কিছু অনুষঙ্গেরও বড় ভূমিকা তাতে৷ সেবারই প্রথম বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ সম্প্রচারিত হলো বিটিভিতে৷ সাদা-কালো থেকে বিটিভির রঙিন যুগে উত্তরণ ঘটেছে বেশ আগেই, তবে
তা মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে ঢুকতে সময় লেগেছে৷ রঙিন টেলিভিশন মধ্যবিত্তের নাগালে আসার সময়টার সঙ্গে মিলে গেছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ আর সেই বিশ্বকাপেই ম্যারাডোনার ওই জাদুকরী ফুটবল৷ রঙিন ছবিতে আরও রঙিন হয়ে উঠেছেন ফুটবল জাদুকর৷ ছোটখাট গড়নের ২৫ বছর বয়সী এক কোকড়াচুলো যুবক বল পায়ে ড্রিবল করতে করতে ঢুকে গেছেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে৷
এতটাই যে, আর্জেন্টিনিয়ানদের কাছেও তা পরিণত হয়েছে এক বিস্ময়ে৷ ম্যারাডোনার কারণে বাংলাদেশের অনেক মানুষ যেমন আর্জেন্টিনাকে চিনেছে, ম্যারাডোনাকে নিয়ে উন্মাদনার কারণেই আর্জেন্টিনার অনেকেও বাংলাদেশকে৷ আমি বলছি আর্জেন্টিনা ঢাকায় খেলে যাওয়ার আগের কথা৷ ২০০৬ বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়েও তো উত্তর দিতে হয়েছে সে দেশের সাংবাদিকদের কৌতুহলী প্রশ্নের, বাংলাদেশে আসলেই কি আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ে?
২০০৪ সালে এথেন্স অলিম্পিকের সময়কার একটা অভিজ্ঞতার কথা তাহলে বলি৷ মিডিয়া সেন্টারে পাশে বসেছেন লোলচর্ম এক সাংবাদিক৷ অলিম্পিক বা বিশ্বকাপে সাংবাদিকদের আলাপ শুরুই হয় কে কোন দেশ থেকে এসেছেন এই প্রশ্ন দিয়ে৷ বর্ষীয়ান ওই সাংবাদিক আর্জেন্টিনার শুনেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে, ‘আর্জেন্টিনা! ডিয়েগো ম্যারাডোনা৷' আমার পরিচয় পাওয়ার তাঁর প্রশ্নেও ম্যারাডোনার অশরীরী উপস্থিতি
থাকল৷ প্রশ্নও একটা নয়৷
‘ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ থেকে বহিস্কৃত হওয়ায় সত্যি সত্যিই কি বাংলাদেশে প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছিল?'
'আর্জেন্টিনা ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালে হারার পর সত্যিই কি এক সমর্থক আত্মহত্যা করেছিলেন?'
দুটি ঘটনার কথাই কোথাও পড়ে থাকবেন৷ কিন্তু ওই সাংবাদিকের কাছে অনুমিতভাবেই তা অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছে৷ এ কারণেই এত দিন পর নির্ভরযোগ্য একটা সূত্র পেয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা৷ তা করেই তিনি থামলেন না৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরও প্রশ্ন করে বাংলাদেশে ম্যারাডোনা-উন্মাদনা নিয়ে নিজের পত্রিকায় একটা স্টোরিও লিখে ফেললেন৷ শিরোনামটা করেছিলেন আমার কথা দিয়েই৷
বাংলাদেশ ও ম্যারাডোনা—এ এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনি!