ভারতের সালতামামি
৩১ ডিসেম্বর ২০১২বিদায়ী ২০১২ সাল মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস জোট সরকারের পক্ষে মোটেই ভালো যায়নি৷ সংসদের ভেতরে ও বাইরে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আর্থিক প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি, বিনিয়োগে টান, বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ব্যর্থতা, প্রশাসনিক শৈথিল্য, দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা এবং সার্বিক দিশাহীনতায় সরকারের পায়ের তলার মাটি ক্রমশই আলগা হয়ে গেছে৷ বিরোধী দলগুলির হাতে সরকারের নাজেহাল অবস্থা৷ এমনকি, জোট সরকারের শরিক দলগুলিও অসন্তুষ্ট৷ তাই সংশয় দেখা দিয়েছে মনমোহন সিং-এর জোট সরকারের টিকে থাকা নিয়ে৷
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সরকারের দুর্বলতা
জুন মাসে পালিত হয় ভারতীয় সংসদের ৬০ বছর৷ তবে সেখানেও সব দলের সাংসদরা ঘন ঘন সংসদের কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করা, হৈ হট্টগোল, স্লোগান, ধরনা ইত্যাদিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন৷ এর অবসানে কোনো সমাধানসূত্র দিতে পারেন নি কেউই৷ ঐ একই মাসে তৃণমূল সরকারের সিঙ্গুর জমি পুনর্বাসন আইন খারিজ হয়ে যায় কলকাতা হাইকোর্টে৷ অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে এই আইন করে মমতা বন্দোপাধ্যায় সরকার৷ কয়লা ব্লক বণ্টনে দুর্নীতির বড়সড় অভিযোগও সামনে আসে৷ দাবি ওঠে প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফার৷
সাতটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আসে সমাজবাদী পার্টি, গুজরাট ও গোয়াতে বিজেপি, মনিপুর, উত্তরাখন্ড ও হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস এবং পাঞ্জাবে আকালিদল ও বিজেপি'র জোট৷ গুজরাটে তিন-তিনবার জিতে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘হ্যাট্রিক' করেন৷ রেলভাড়া বাড়ানোর কারণে তৃণমূলের চাপে ইস্তফা দিতে হয় রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীকে৷ টু-জি স্পেকট্রামের ১২২টি লাইসেন্স অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট৷ যদিও খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে সংসদে তুমুল বিতর্কের পর, ভোটাভুটিতে জিতে যায় সরকারপক্ষ৷
এছাড়া, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটে৷ নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলমান খুরশিদ, রেলমন্ত্রী পবন বনশাল, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মনীষ তেওয়ারি আইন মন্ত্রী বিরাপ্পা মইলি৷ ২০১২ সালে দ্বিতীয়বার উপরাষ্ট্রপতি হন হামিদ আনসারি৷ আর প্রথম বাঙ্গালি রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়৷
বৈদেশিক সম্পর্ক ও বিভিন্ন নেতার ভারত সফর
পররাষ্ট্র নীতির দিক থেকেও সরকারের দু'নৌকায় পা দিয়ে চলার স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতিতে, বিশেষ করে প্রতিবেশি দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, উন্নতি চোখে পড়েনি৷ তা সে বাংলাদেশ হোক বা পাকিস্তান, মিয়ানমার হোক বা চীন৷ তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার প্রধান এবং নেতা নেত্রীদের ভারত সফরে কোনো ঘাটতি ছিল না৷ বিদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ সফরগুলির মধ্যে ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ত্রিপুরা সফর, দিল্লি সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি, অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী রেহমান মালিক, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি, আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিন, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট প্রমুখ৷
ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে ইসরায়েলি কূটনীতিকের প্রাণনাশের চেষ্টা হয়৷ গাড়িবোমা বিস্ফোরণে আহত হন তিনি৷ অভিযোগের আঙুল ওঠে ইরানের দিকে৷ বিতর্ক হয় জয়পুর সাহিত্য উৎসবে বিশ্বখ্যাত লেখক সলমান রুশদির যোগদান নিয়ে৷ কেরালার উপকূলে একটি ইটালীয় জাহাজের নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারায় দু'জন ভারতীয় মৎসজীবী৷
বিক্ষোভ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনা
কুড়ানমকুলম পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করা যায় ২০১২ সালে৷ ছত্তিশগড়ের এক জেলা কালেক্টর মাওবাদীদের হাতে হন অপহৃত এ বছর৷ মে মাসে ভয়ঙ্কর নৌকাডুবি ঘটে আসামের ব্রহ্মপুত্র নদে৷ মারা যায় একশ'রও বেশি মানুষ৷ উদ্ধারকাজে সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির প্রতিবাদে ভারত বনধও দেখা যায়৷ আসামের কোকরাঝাড় জেলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশ ইস্যুতে জাতিদাঙ্গার ঘটনা ঘটে৷ বোড়ো ও বাংলাভাষী মুসলিমদের মধ্যে ঐ দাঙ্গায় মারা যান প্রায় ৮০ জন৷ নিখোঁজ হন আরো ১২ জন৷ প্রায় চার লাখ পরিবার ঘরছাড়া৷
এরপর ২৬/১১-র মুম্বই হামলার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী আবু জুন্দল দিল্লিতে গ্রেপ্তার হয়৷ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয় ১৯ জন মাওবাদী৷ ফাঁসি হয়ে যায় মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার একমাত্র ধৃত আসামি আজমল কাসভের৷ পুলিশের জালে ধরা পড়ে পুনে বিস্ফোরণের সন্ত্রাসী৷ ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্তদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় এ বছরই৷ এছাড়া, সাফল্যের সঙ্গে পাঁচ হাজার কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে ভারত৷
বছরের শেষের দিকে দিল্লির চলন্ত বাসে তরুণীর গণধর্ষণের ঘটনায় গোটা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ চলে লাগাতার বিক্ষোভ৷ রাস্তাঘাটে মহিলাদের নিরাপত্তা এবং ধর্ষকদের কঠিন শাস্তির দাবি করে মানুষ৷
সংস্কৃতি-বিনোদন এবং খেলার জগতে প্রাপ্তি
ভারতে জার্মান বর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়৷ ভারত-জার্মান তথা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা৷
এ বছরেই প্রয়াত হন কয়েকজন কৃতি সন্তান৷ অন্যতম বাংলা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সংগীত জগতের নক্ষত্র পণ্ডিত রবি শঙ্কর, বলিউড তারকা রাজেশ খান্না, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আই.কে গুজরাল এবং শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে এঁদের মধ্যে অন্যতম৷ জনপ্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পান ২০১১ সালের জন্য দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার৷
এ বছর খেলার জগতের উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ওয়ান-ডে ক্রিকেট থেকে শচীন তেন্ডুলকর এবং রাহুল দ্রাবিড়ের অবসর৷