বেঙ্গালুরুতে যৌন নিপীড়ন
৫ জানুয়ারি ২০১৭ভারতের বেঙ্গালুরু শহরে বর্ষ বিদায়ের আনন্দ উল্লাসের রাতে উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা একাধিক মহিলার ‘শ্লীলতাহানি' করে৷ এই ঘটনায় দেশজুড়ে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়৷ প্রথমদিকে কর্নাটক সরকার ঘটনাকে আমল দিতে চায়নি৷ পরে চাপে পড়ে তদন্ত শুরু করেছে৷
দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্নাটকের বেঙ্গালুরু শহরে বর্ষ বিদায়ের রাতে যেভাবে লাগামছাড়া বেলেল্লাপনা দেখা গেছে, তা এক কথায় বেনজীর৷ তথ্য প্রযুক্তির ঘাঁটি বলে খ্যাত এই শহরের প্রাণকেন্দ্র এম.জি রোড এবং ব্রিগেড রোডে মধ্যরাতে জড়ো হয় প্রায় ৫০-৬০ হাজার তরুণ-তরুণী৷ সবাই আনন্দ উল্লাসে মাতোয়ারা৷ কিন্তু সেই আনন্দ নিবিড় আবহ হয়ে পড়ে এক বিভীষিকা৷ উচ্ছৃঙ্খল কিছু যুবক অবাধে চালায় তরুণীদের ওপর যৌন নিগ্রহ৷ জড়িয়ে ধরে, দেহের আপত্তিকর জায়গায় হাত রাখে, চুম্বন করে৷ মেয়েদের মধ্যে শুরু হয় পরিত্রাহি চিৎকার৷ জুতো হাতে ছুটাছুটি শুরু করে৷ পুলিশ অবশ্যই ছিল৷ সরকারের মতে হাজার দেড়েক৷ প্রাথমিকভাবে পুলিশ প্রশাসন এইসব ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করেনি৷ পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের মাঝে মধ্যে দু -একবার তাড়া করে মাত্র৷ পরে এই নিয়ে যখন দেশে ক্ষোভের তুফান ওঠে, তখন সাফাই দিতে গিয়ে কর্নাটক রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন তাতে আগুণে ঘি পড়ার মতো৷ সংবাদ মাধ্যমের সামনে নির্লিপ্তভাবে তিনি বলেছেন, পশ্চিমী ভাবধারা নকল করতে গিয়ে এসব ঘটেছে৷ বড়দিন বা বর্ষবরণের আনন্দ উল্লাসের রাতে এমন একটু-আধটু ঘটেই থাকে৷ পশ্চিমী মানসিকতায় রপ্ত কিছু যুবক সংযম হারিয়ে ফেলে. পুলিশ ছিল, তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে৷ লিখিত কোনো অভিযোগ কেউ এখনও পর্যন্ত করেনি৷ অকাট্য প্রমাণও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি৷
মন্ত্রীর এই ধরণের কুরুচিকর মন্তব্যকে ধিক্কার জানিয়ে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ললিতা কুমারমঙ্গলম মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানান৷ দিল্লি মহিলা কমিশনের প্রধান কর্নাটকের মন্ত্রী সমাজবাদী পার্টির নেতা আবু আজমির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন৷ কুরুচিকর মন্থব্য করেছেন সমাজবাদী দলের নেতা আবু আজম৷ মেয়েরা ছোট পোশাক পরে রাতবিরেতে পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে গেলে এমনটা ঘটতেই পারে৷ মহিলাদের নিরাপত্তা শুরু হওয়া দরকার বাড়ি থেকেই৷ ভারতীয় সংস্কৃতি অন্তত তাই বলে৷
এরপরেই সামনে আসে অকাট্য প্রমাণ৷ সিসিটিভি ফুটেজ৷ তাতে দেখা যায় শহরের অন্য জায়গায় স্কুটারে আসা তিনজন যুবক অটোতে আসা দুই তরুণীকে কিভাবে যৌন হেনস্থা করছে৷ সোশ্যাল মিডিয়াতে তা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত৷ নড়েচড়ে বসে পুলিস প্রশাসন৷ বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, কিছু প্রমাণ হাতে এসেছে৷ শহরের ৪০টি সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ করেছে৷ তদন্ত শুরু হয়েছে এবং পুলিশের ডেপুটি কমিশনার পদমর্যাদার এক অফিসারের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশনও গঠন করা হয়েছে৷
প্রশ্ন উঠেছে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে৷ জোর বিতর্ক উঠেছে মেয়েরা কি তাঁদের পছন্দমতো পোশাক পরে রাতে বাইরে যেতে পারবে না? না পারলে পুলিশ প্রশাসন আছে কেন? মহিলাদের নিরাপত্তা রক্ষায় কেন সরকার বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন? কড়া শাস্তির বিধান কেন নেই?
কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধীর উত্তর, আইন কড়া করলেই যে এই ধরনের অপরাধ কম হবে, তার নিশ্চয়তা নেই৷ আসলে তরুণ প্রজন্মের একাংশ হতাশায় ভুগছে৷ চাকরি নেই, শিক্ষাদীক্ষার অভাব, ভবিষ্যত অন্ধকার৷ মনের হতাশা জাগিয়ে তুলছে হিংসার মনোভাব৷ সমাজের দুর্বলতর লিঙ্গের ওপর জোর খাটাতে চাইছে৷
নারী নিরাপত্তার সূচিতে ভারতের স্থান একেবারে নীচের দিকে৷ তবে সরকার হাত গুটিয়ে বসে নেই৷ চালু করতে চলেছি মোবাইলে বিপদ সঙ্কেত বাটন৷ ঐ বোতামে চাপ দিলেই বিপদ সংকেত পৌঁছে যাবে কাছের পুলিশ থানায় এবং অন্যদের কাছে৷ সেইসঙ্গে থাকছে জিপিএস সিস্টেম যাতে বিপদাপন্ন মহিলা কোথায় আছেন তা জানা যায়৷ এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান মানেকা গান্ধী৷
জাগরি নামের এক মহিলা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মুখপাত্র ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন, চলতি আইনকানুন যা আছে, তা আছে৷ আইন কড়া করাই যথেষ্ট নয়৷ আসল কথা, চলতি আইন প্রয়োগে রয়ে গেছে ঢিলেমি৷ দ্বিতীয়ত, পুরুষদের সামাজিক মানসিকতায় আনতে হবে পরিবর্তন৷ নারীদের যে একটা আলাদা ব্যক্তিপরিচয় আছে, সেটাকে সম্মান করতে শিখতে হবে৷ মহিলা বলেই তাঁকে অন্য চোখে দেখতে হবে, এ কেমন কথা? শুধু দেশের নয়, বিদেশি মহিলাদেরও ভারত ভ্রমণে এসে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে কেন? ডয়চে ভেলের এই প্রশ্নের উত্তরে এনজিও জাগরি-র বক্তব্য, এটা দেশি বা বিদেশি মহিলার কথা নয়, এটা বিশ্বের গোটা নারী সমাজের কথা৷ জনবহুল দেশে যৌন হেনস্থার ঘটনা বেশি হয়, এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে জাগরি-র মুখপাত্র বলেন, জনসংখ্যার কথা নয়, নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতা৷ শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচির কথা৷
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরে বেলজিয়াম, জার্মানি, ডেনমার্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উগান্ডার নারীরা ভারতে এসে ধর্ষিতা হন৷ তা-ও এর বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে রাজধানী দিল্লিতে৷ নির্ভয়া গণ ধর্ষণকাণ্ডের পর মহিলাদের নিরাপত্তা আইন কঠোর করতে গঠিত হয় ভার্মা কমিশন৷ কমিশনের রিপোর্টে বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়৷ বলা হয় ‘ফাস্ট-ট্র্যাক’ বিচারের কথা৷ তিন মাসের মধ্যে বিচার পর্ব শেষ করে অপরাধিকে শাস্তি দিতে হবে৷ পুলিশকে সেই অনুযায়ী যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করতে হবে৷ কিন্তু কোথায়? সবই বন্দি কাগজে-কলমে৷ ভারতে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ বা যৌন লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে৷
বিষয়টি নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷