1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বঞ্চনার প্রতিবাদে এবার দলিতদের ‘ভীম র‍্যাপ'

পায়েল সামন্ত
২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে গান চিরকাল প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে৷ সেই দলে ভিড়ল পপ, হিপ-হপ, কিংবা র‍্যাপ৷ ইউটিউবের সৌজন্যে ভারতে জাতিভেদের বিরুদ্ধে গানের মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন নতুন প্রজন্মের গায়করা৷

https://p.dw.com/p/3AkPa
ছবি: Reuters/S. Andrade

জাতপাত এবং বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে ভারতীয় সমাজে যে সমস্যা রয়েছে, তা আজকের নয়৷ বহুযুগ আগে থেকেই সমাজের বুকে জাতিভেদের ঝান্ডা পোঁতা রয়েছে৷ ভারতীয় সংবিধানে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণের সমানাধিকারের কথা বলা হলেও সমাজজীবনে তার ব্যাতিক্রম দেখা যায় অহরহ৷ ‘দলিত' শ্রেণির মানুষদের প্রতি তথাকথিত উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি আজও৷ 

চিরাচরিত এই ভাবনাকে পাল্টাতে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সংগীত৷ তবে সেই সংগীত কোনো আঞ্চলিক সুরে নয়, বরং রক, পপ, হিপ-হপে৷ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই গান শুনছে৷ দলিত সম্প্রদায়ের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের কথা পশ্চিমী সুরে বেঁধে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ই-দুনিয়ায়৷ তাঁরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে গর্বিত৷ তাঁদের বক্তব্য, মূল ধারার সংগীত জগতে দলিত শিল্পীদের লোকশিল্পী বলে মনে করা হতো৷ তাঁরা প্রমাণ করতে চান, তাঁদের ওই গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা যাবে না৷

গিন্নি মাহি

বছর কুড়ির গিন্নি মাহি পাঞ্জাবের জলন্ধরের বাসিন্দা৷ ইউটিউবের লক্ষ লক্ষ শ্রোতা-দর্শকের জন্য তিনি আজ অতি পরিচিত নাম৷ এ বছরই জার্মানির বন শহরে ডয়চে ভেলের গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের উদ্বোধনী মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন তিনি৷ গিন্নি তাঁর নিজের পরিচয় তৈরি করে ফেলেছেন বছর তিনেক আগেই৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর ‘ফ্যান বাবা সাহেব দি', ‘ডেঞ্জার', ‘ডেঞ্জার ২' ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়েছিল৷ গিন্নি এখন পড়াশোনা করেন, তার পাশাপাশি এই পপ সংগীতেও ভবিষ্যৎ গড়তে চান৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গিন্নি বলেন, ‘‘আমার গান কিছুটা পপ, কিছুটা হিপ হপ আর সাধনার গান৷ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর আমার অনুপ্রেরণা৷''

জাতিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে  ‘চামার পপ'  ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ ‘চামার' শব্দটি অবজ্ঞাসূচক, এটি নিম্নবর্গের মানুষকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়৷ তারই নামে পপ সংগীত সামনে এনে জাতিভেদের বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা হয়েছে৷ গিন্নির গান সেই ধারাতেই মানুষের মন কেড়েছে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘চামার শব্দটি মানুষের অবমাননা করতে ব্যবহার করা হয়৷ তাই ওই নাম নিয়ে সাম্যের গান গাওয়া হচ্ছে৷ লক্ষ্য একটাই, যতটা সম্ভব বেড়া ভেঙে ফেলা৷'' কতটা সাফল্য পাচ্ছে এই উদ্যোগ? গিন্নি মাহি বলেন, ‘‘সাফল্যের কথা এখনই বলতে পারছি না৷ কিন্তু মানুষের চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন আসছে৷ তবে ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকটাই সাড়া মিলেছে৷''

জয়ন্ত বর্মন

জাতিভেদবিরোধী গানে শুধু একক গায়ক-গায়িকা নয়, গানের দলেরও অস্তিত্ব রয়েছে৷ ভীম র‍্যাপের মাধ্যমে একইভাবে জাতিভেদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হচ্ছে৷ এসব গানের অন্যতম বিষয়বস্তু ভীমরাও আম্বেদকর৷ তিনি ভারতের সংবিধান প্রণেতা৷ এ দেশের দলিত সমাজের কাছে তিনি আইকন৷ তাঁর নামেই ‘ভীম র‍্যাপ'৷ আম্বেদকরের জীবন ও কর্ম নিয়ে গান বাঁধা হয়েছে৷ ১৯ সদস্যের একটি ব্যান্ড বা গানের দল এই সংগীত পরিবেশন করে৷ এই দলের নাম ‘দ্য কাস্টলেস কালেকটিভ'৷ এই ধরনের গানের প্রচার কেবল ই-দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ নেই৷ বিভিন্ন মঞ্চে এই ব্যান্ড সাড়া জাগিয়েছে৷

গিন্নি মাহির মতো জাতিভেদবিরোধী র‍্যাপ গানে সাড়া জাগিয়েছেন দলিত সমাজের প্রতিনিধি, তরুণ গায়ক সুমিত সামোস৷ ইংরেজি, হিন্দি ও ওড়িয়া ভাষায় গান পরিবেশন করেন তিনি৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওড়িশার কোরাপুটে আমি বড় হয়েছি৷ সমাজে কতটা বৈষম্য রয়েছে, সেটা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি৷ নীচু জাতের মানুষদের জন্য আলাদা কলোনি ছিল৷ তাঁদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে কিনা, কোথা থেকে তাঁরা পানীয় জল সংগ্রহ করবে, এসব ঠিক হতো জাত পরিচয় দেখে৷'' ২৬ বছরের সুমিতের গাওয়া ‘লড়াই সিখ লে' গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির তরুণদের মধ্যে৷

পল্লব কীর্তনীয়া

সিকিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতের অধ্যাপক জয়ন্ত বর্মন অবশ্য জাতপাতভিত্তিক গানকে সমর্থন করছেন না৷ তাঁর মন্তব্য, ‘‘যাঁরা এসব গান গাইছেন, তাঁরা নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নয়৷ এঁরা মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়েছেন৷ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, পরম্পরা আছে৷ সেই ঐতিহ্য ভুলে এ ধরনের গানে ঝুঁকে পড়া কোনো ইতিবাচক ব্যাপার নয়৷ র‍্যাপের মাধ্যমে এই শিল্পীরা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছতে চাইছে, এটা ভাবার কারণ নেই৷ নিজেদের বাদ্যযন্ত্র বাদ দিয়ে পশ্চিমী বাদ্যযন্ত্র আঁকড়ে ধরার কোনো মানে হয় না৷'' তবে এ জন্য গিন্নি মাহিদের মতো গায়কদের দায়ী করতে রাজি নন অধ্যাপক৷ তিনি বলেন, ‘‘এঁদের ঠিকভাবে গাইড করা হচ্ছে না৷ তাই এঁরা নিজেদের অতীত সম্পর্কে পরিচিত হতে পারছেন না৷ এ কারণে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগোতেও পারছেন না৷''

চেতনার গানের শিল্পী পল্লব কীর্তনীয়া অবশ্য গিন্নি-সুমিতদের উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যুবসমাজের এই ভাবনা প্রশংসনীয়৷ এটা বড় ধরনের কাজ৷ জাতিভেদের বিরুদ্ধে গান হাতিয়ার হতেই পারে৷ পশ্চিমী সুরকে কাজে লাগিয়ে ওঁরা তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছতে পারছেন৷ তবে শুধু শহুরে মানুষদের কথা ভেবে গান করলে হবে না৷ নিজের শিকড়ের গানও তুলে আনতে হবে৷ কিন্তু, আমাদের দেশের কত অংশের মানুষ ইউটিউব দেখেন, সেটাও ভাবতে হবে৷ সেটা দেখলে বোঝা যাবে, খুব বেশি মানুষের মধ্যে এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে না৷''