‘বছরে ২০ লাখ মানুষকে কাজ দেয়াটাই চ্যালেঞ্জ’
২৮ নভেম্বর ২০১৬তাঁর কথায়, ‘‘ বাংলাদেশ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে কৃষির বিভিন্ন খাতে প্রায় ২২ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোগকে অর্থায়ন করা হচ্ছে৷ এর মধ্যে নতুন ধরনের ফসল ও পণ্য উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন প্রায় তিন লাখ উদ্যোক্তা৷আমরা এখন টাকার ব্যবস্থা করছি, প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছি, তাদের বাজারজাতকরণে সহায়তা করছি৷ সে কারণে অনেকে এগিয়ে আসছে৷ তবে এখনো অনেক পথ বাকি আছে৷''
ডয়চে ভেলে : বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণরা এখন কৃষিকাজে এগিয়ে আসছে, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ : আমার মনে হয় এটা করা উচিৎ৷ কারণ আমাদের কর্মসংস্থান দরকার৷ তরুণ প্রজন্ম যদি এই কাজে না আসে তাহলে দেশের অগ্রগতি যত তাড়াতাড়ি হওয়া উচিৎ তা হবে না৷ কারণ আমাদের দেশে অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে কম বয়সের ছেলে-মেয়ে৷ অতত্রব এগিয়ে আসছে এটা সুখবর৷ এই এগিয়ে আসার জন্য কিছু কাজ করতে হচ্ছে৷ আগে শিক্ষিত হলে কৃষিতে আসতে চাইত না, এটাই ছিল এখানের মোটামুটি ব্যবস্থা৷ এখন এমন অনেক ছেলে-মেয়ে গ্রামে এমনকি শহরেও আছে যাদের কর্মসংস্থান নেই, বেকারত্ব তাদের উপর চেপে বসছে৷ এ অবস্থায় তারা কিছু কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে, যেখান থেকে তাদের উপার্জন হতে পারে৷ এই আগ্রহটাকে কাজে লাগাতে হবে৷ আমরা সেটাই করার চেষ্টা করছি৷ আমারা তাদের প্রশিক্ষন দিচ্ছি, অর্থ দিচ্ছি৷ এক সময় অর্থায়নও হতো না৷ টাকা পাওয়া যেত না৷ আমরা এখন টাকার ব্যবস্থা করছি, প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছি, তাদের পন্য বাজারজাতকরণে সহায়তা করছি৷ সে কারণে অনেকে এগিয়ে আসছে৷ তবে এখনো অনেক পথ বাকি আছে৷
সরকারের পক্ষ থেকে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে বা সহায়তা দিতে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
সরকারের পক্ষ থেকে তো অনেকগুলো পদক্ষেপ আছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ ‘চাকরি না খুঁজে চাকরি দাও-' এই ধরনের একটা স্লোগান সরকারের আছে৷ যারা আসছে, তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষনও দেয়া হয়৷ শুধু কৃষি নয়, কৃষির বাইরেও প্রশিক্ষন দেয়া হয়৷ আমি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান৷ এটাও সরকারি প্রতিষ্ঠান৷ আমরাও সরকারের নীতির আঙ্গিকে কাজ করি৷ আমরা দুটো কাজ করছি, একটা হলো তাদের দক্ষতা দিয়ে কাজ করা আর অপরটি হলো তাদের মানবিক মূল্যবোধ যাতে বিকশিত হয় সেদিকে নজর দেয়া, কারণ, অনেক তরুণ বিপথে যাচ্ছে৷ তাদের যাতে ফিরিয়ে আনা যায়৷ আমরা তাদের দক্ষতা সৃষ্টিতেও নজর দিচ্ছি, যাতে তারা কাজ করে আয়-উপার্জন বাড়াতে পারে৷
এই তরুণদের আপনারা কিভাবে কৃষিতে আনলেন?
একটা উদাহরণ দেই৷ একটা ছেলে এমএ পাশ করে গ্রামে যাচ্ছে৷ সেখানে গিয়ে বেশ কিছুদিন কিছু করার চেষ্টা করেছে৷ এরপর শহরে ফিরে চাকরির চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু চাকরি সে পায়নি৷ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন সরাসরি কাজ করে না৷ আমাদের কিছু সহায়ক এনজিও আছে৷ তাদের মাধ্যমে কাজ করি৷ এমন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে প্রস্তাব দেয়া হলো, ‘‘তুমি যদি কিছু করতে চাও, আমরা সহায়তা করব৷'' শেষ পর্যন্ত সে রাজি হলো এবং একটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করল৷ দুই- তিন বছরের মধ্যে তার অনেকগুলো পুকুর হয়ে গেছে৷ এখন সে স্বচ্ছল৷ গ্রামে আমি দেখেছি, একটা কাজ করে একজন যদি সফলতা পায় তাহলে আরো অনেকেই ওই কাজে আগ্রহী হয়৷
তরুণরা এত কাজ থাকতে কেন কৃষিতে আসবে? আপনি কী মনে করেন?
এত কাজ নেই তো৷ ব্যাপারটা হচ্ছে, কাজ পাওয়া যায় না বলেই তো আসছে৷ প্রতি বছর নতুন ২০ লাখ মানুষ কাজের বাজারে আসছে৷ সেই পরিমান কাজ তো সৃষ্টি হচ্ছে না৷ আর এখন তো কৃষি মানে শুধু ধান আর গম না৷ মাছ চাষ, গাভী পালা, মুরগি পালা এ সবই কিন্তু কৃষির মধ্যে৷ সবগুলোতেই তারা আসছে৷ এখানে আমরা প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছি, অর্থায়ন হচ্ছে৷ কখনও কখনও আমরা অনেককে নিয়ে একসঙ্গে প্রশিক্ষন দেই৷ যে যেটা নিতে চায়, কেউ কৃষিতে যেতে চায়, কেউ মাছ চাষ করতে চায়, যে যেটা করতে চায় আমরা সেদিকে তাকে প্রশিক্ষন দেই৷
কৃষির চেয়ে শিল্প বা প্রযুক্তিতে প্রবৃদ্ধি বেশি৷ তাদের যদি সেদিকে নিতে পারলে তো রাষ্ট্রের লাভ, নাকি?
অবশ্যই৷ দেশের লাভ, ওদের নিজেদের লাভ, সমাজের লাভ, এমনকি ওদের পরিবারেরও লাভ৷ একজন পিছিয়ে পড়া মানুষ, যার আয়-উপার্জন নেই, তার যদি আয়-উপার্জন বাড়ে, তাহলে তার নিজের উন্নতি হয়, পরিবারের উন্নতি হয় এবং জাতীয় আয়েও সংযোজিত হয়৷ এতে আরেকটা কাজ হয়, সেটা হলো বৈষম্য কিছুটা কমে আসে৷
তরুণরা কৃষিকাজ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা ও কারিগরিসহায়তা কি পাচ্ছে?
প্রয়োজনীয় বলব না, কারণ পাচ্ছে, কিন্তু সেটা আরো বাড়ানো দরকার৷ আমি তো পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের কথা বললাম, আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও করছে৷ এটা আগাচ্ছে, তবে আরো সময় লাগবে৷ এখনো বেকারত্ব অনেক ব্যাপক৷
যে তরুণের অর্থ নেই, জমি নেই, কিন্তু শিক্ষিত, সে কিভাবে কৃষিতে সম্পৃক্ত হবে?
অর্থ তো বললাম আমরা পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন থেকে দেই, অন্য প্রতিষ্ঠানও দেয়, আমরা প্রশিক্ষনও দেই৷ সুতারাং তার যদি জমি না-ও থাকে, আগে যে উদাহরণ দিলাম যে পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেছে, সেটা করা সম্ভব৷ সবার যে ধান করতে হবে তা না৷ সবজি করাও তো কৃষি৷ বিভিন্নজন বিভিন্ন রকমের কাজ করছে৷ মাছটা বেশ ব্যাপক আকারে হচ্ছে৷ একটা ভুল ধারণা হয়েছে, কৃষি বললে মানুষ মনে করে ধান৷ শুধু এটা না, অন্যসবও কৃষি৷
বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় তরুণদের আপনারা কৃষিতে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন?
অনেক এলাকায়৷ আমাদের তো সারাদেশে কাজ আছে৷ প্রতিটি উপজেলায় কাজ আছে৷ বিশেষ করে ১৫০টি ইউনিয়নে আমরা কাজ করছি৷ যেমন উপকূলীয় এলাকা আছে, যেখানে খরা আছে সেখানেও কাজ আছে৷ লালমনিরহাটসহ সব এলাকায়ই আমাদের কাজ আছে৷ ফলে এক জায়গায় না সবজায়গাতেই কিছু কিছু কাজ হচ্ছে৷ অনেক এলাকা বাকি আছে৷ আমাদের আরো অনেকদূর যেতে হবে৷
আমাদের দেশে তো হাজার হাজার তরুণ এখনো বেকার৷ তাদের মধ্যে আপনারা যাদের সহযোগিতা করছেন, তাদের বাছাই করছেন কিভাবে?
আমরা ১৫০টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিকে সহায়তা দিচ্ছি৷ এখানে বাছাই করার কোনো ব্যাপার নেই৷ এই ১৫০টি ইউনিয়নে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করছি৷ অন্যান্য জায়গায় তো আমরা সবাইকে দিতে পারি না৷ শুধু যারা উৎসাহিত হয়, তাদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করি৷ যুব উন্নয়ন অধিদপ্ততর তো সারাদেশেই কাজ করছে৷ তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষন দিচ্ছে৷ সুতারাং প্রশিক্ষন আস্তে আস্তে বাড়ছে৷ প্রশিক্ষন হলে অর্থায়নের ব্যবস্থাও বিভিন্নভাবে হয়৷ আসলে যতটা প্রয়োজন, ততটা এখনো সম্ভব হয়নি৷ আশা করি ভবিষ্যতে অর্থায়ন আরো বাড়বে এবং তরুণরা আরো এগিয়ে আসবে৷
সরকারের কাছে এই মুহুর্তে তরুণদের জন্য আপনার কী চাওয়ার আছে?
আমার কিছু চাওয়ার নেই৷ আমি চেষ্টা করছি৷ সরকারের একটা নীতি আছে৷ সেই নীতির আওতায় যে কাজগুলো হচ্ছে, সেগুলো যেন আরো সঠিকভাবে হয়৷ আমাদের নীতির কোনো সমস্যা নেই৷ সমস্যা হলো যেভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা সেভাবে বাস্তবায়ন হয় না৷ যাদের জন্য এই উদ্দেশ্য তাদের কাছে অনেক সময় এটা পৌঁছায় না৷ সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে যার যেটা প্রাপ্য সেই জায়গায় যদি আমরা ভালো করে কাজ করতে পারি, দেশটা এমনিতেই এগিয়ে যাচ্ছে, তাহলে আরো অনেক বেশি এগিয়ে যাবে৷
তরুণদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
ওদেরকে আমি দুই-তিনটা জিনিস বলি৷ যারা পড়াশোনা করছে, তাদের ভালোভাবে পড়াশোনাটা করতে হবে৷ পড়াশোনা শেষ হলে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা আছে৷ প্রশিক্ষন নিতে হবে এবং সেটা কাজে লাগাতে হবে৷ আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমি এই কাজটা করব৷ আর আমি যদি আরেকটা কাজ চাই, কিন্তু পাচ্ছি না, তাহলে কিন্তু হবে না৷ সিদ্ধান্তটা নিতে হবে যে আমি এই কাজটা করব৷ অনেকের সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে৷ কেউ অঙ্গীকার নিয়ে এলে সে ভালো করবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷