বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মমতাজ
২৫ জুন ২০১১ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার কসবায় ১৯৪৬ সালে ১৩ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন মমতাজ বেগম৷ পিতা আব্দুল গণি ভূইঞা এবং মা জাহানারা খানম৷ সংগ্রামী পিতাকে সেই ছোট্ট থেকেই ভাষা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে দেখেছেন মমতাজ৷ ফলে ছোট্ট থেকেই ভাই-বাবাদের সাথে ভাষা আন্দোলনে শরিক হন তিনি৷ এমনকি যখন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী, তখনই শিশু মমতাজ ভাইদের হাত ধরে মিছিলে হাজির হন৷ রেললাইন অবরোধের অংশ হিসেবে অন্যদের সাথে শিশু মমতাজও শুয়ে পড়েন রেললাইনের উপর৷ সেই থেকে সংগ্রাম আর আন্দোলনের শুরু মমতাজ বেগমের৷
এরপর দেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে প্রত্যেক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন মমতাজ৷ ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন বাতিলের আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, '৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানসহ সকল আন্দোলনে সামনের সারিতে হাজির ছিলেন তিনি৷ ছাত্র জীবনে কুমিল্লা মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এছাড়া ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হন৷ এসময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পরিষদ সিদ্ধান্ত নিল সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করার৷ এই প্রস্তাব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে তিনি তাদেরকে এই বলে বোঝান যে, এসময় সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করলে তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে৷ তাই আগে দেশে নির্বাচন হবে তারপর স্বাধিকার আদায়ের পন্থার দিকে এগুতে হবে৷ ফলে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সবাই৷
নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পরিষদে সাত জন নারী প্রতিনিধির একজন ছিলন মমতাজ বেগম৷ পহেলা মার্চ নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয়৷ কিন্তু বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা৷ ফলে পূর্বাণীর দলীয় কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে হাজির হন মমতাজ৷ সেখানে সাংবাদিক সম্মেলনের এক পর্যায়ে একটি চাদরের চারিদিক ধরে বঙ্গবন্ধুর সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য যেসব নেতা-নেত্রী শপথ নিয়েছিলেন মমতাজ তাঁদের মধ্যে অন্যতম৷ তখন থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য হলে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে থাকেন মমতাজ এবং তাঁর সহকর্মী নেত্রীরা৷ একইসাথে নিজেরাও প্রশিক্ষণ নেন৷
২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে পরিকল্পনা মাফিক শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতে থাকেন মমতাজ৷ পরিস্থিতি বিবেচনা করে কয়েকদিন পরেই আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন৷ এসময় কুমিল্লা হয়ে নিজ শহর কসবায় পৌঁছে এক স্মরণীয় ঘটনার সম্মুখীন হন মমতাজ৷ তিনি জানান, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কর্মরত স্থানীয় জনতা একজন ব্যক্তিকে পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসেবে আটক করে৷ তখন মমতাজ বেগমের পিতার কাছে সেই আটক ব্যক্তিকে আনা হলো৷ তারপর দেখা গেল গুপ্তচর সন্দেহে আটক ব্যক্তি আর কেউ নন৷ বরং স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানী৷ তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁকে আগরতলায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়৷
এরপর ১০ এপ্রিল গঠিত অস্থায়ী সরকার তথা মুজিব নগর সরকারে নারী প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন মমতাজ বেগম৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স তথা বিএলএফ-এর পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে নীতি-কৌশল নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ প্রশাসনিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন তিনি৷ এই বাহিনীর রসদ-পত্র সংরক্ষণের দায়িত্বও ছিল মমতাজের৷ এই সংকটকালীন সময়েও তাঁর বাড়িতে চুরির ঘটনার কথা জানালেন তিনি৷ বললেন, তাঁর বাড়িতে যুদ্ধের জন্য সংগৃহীত টাকা-পয়সা রাখা হয়েছিল৷ একরাতে চোর এসে ঘরে থাকা একটি সিন্দুক নিয়ে যায়৷ কিন্তু সেই সিন্দুকে যুদ্ধের টাকা ছিল না৷ বরং মমতাজের নিজস্ব স্বর্ণালংকার রাখা ছিল৷ সেগুলো নিয়ে যায় চোর৷ কিন্তু যুদ্ধের টাকা-পয়সা অন্যত্র ছিল বলে সেগুলো বেঁচে গিয়েছিল৷ নিজের অলংকারের বিনিময়ে হলেও যুদ্ধের টাকা-পয়সা যে রক্ষা হয়েছিল তাতেই খুশি হয়েছিলেন দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গকারী এই বীর নারী৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ