‘বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করলে সংকট কেটে যাবে'
১৭ মার্চ ২০১৫বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের মতো যাঁরা তাঁর অনুসারী নন তাঁদেরও অনেকেই মনে করেন, তিনি ছিলেন এক বড় মাপের নেতা৷ তাঁর মধ্যে ছিল ‘স্টেটম্যানশিপ', তাই যে কোনো সংকটে যে কোনো পরিস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান খুঁজতে চাইতেন তিনি৷ তবে সব আলোচনায় তিনি ঊর্ধে তুলে ধরতেন দেশের মানুষের স্বার্থ৷ তাঁর চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িতা ও গণতন্ত্র৷
বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ এই সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক বিষয়৷ একে শুধু দুই দলের বিরোধিতার একটি সংকট হিসেবে দেখছেন না অনেকেই৷ শুধু ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে এই সংকট তা মনে করার কারণ নেই৷ এর সঙ্গে আছে যুদ্ধাপরাধের বিচার৷ স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ৷ গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতাসহ আরো কিছু ইস্যু৷ আছে সংবিধান স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া দেশের রাজনীতির চরিত্র এবং আমাদের ভবিষ্যৎ যাত্রার বিষয়টিও৷
এর আগের (৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের) মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে৷ এই বিচার প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার মুখে পড়ে৷ আর তাদের প্রধান মিত্র বিএনপি এক ‘অদ্ভূত' অবস্থান নেয়৷ তারা একদিকে বিচারের কথা বলে, আবার ট্রাইবুন্যাল ভেঙে দেয়ারও কথা বলে৷ যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রতিহত করতেই বাংলাদেশে ব্যাপক সন্ত্রাস হয়৷ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশে নজীরবিহীন সহিংসতা হয়েছে৷ সেই সহিংসতা অন্য রূপে এখনো অব্যাহত৷
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির ‘একতরফা' নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আরো একদফা ব্যাপক সহিংসতা হয়৷ তারপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি৷ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ও তার মিত্ররা এ বছরের ৬ই জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ আর হরতাল পালন করে আসছে৷ মঙ্গলবার সেই কর্মসূচির ৭০ তম দিনে আবার হরতালের কর্মসূচি এসেছে৷ গত দু’মাসের অবরোধ হরতালে এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন৷
গত শুক্রবার বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সংকট নিরসনে সংলাপের আয়োজন করার দাবি জনিয়েছেন৷ তবে তিনি হরতাল- অবরোধ প্রত্যাহার করেননি৷ জবাবে সরকার বলেছে, যারা পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ হত্যা করে, তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে না৷
বাংলাদেশের সংবিধান এ পর্যন্ত ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে৷ এ সব সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মূল চরিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে৷ সংবিধানের মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও পরে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে ইসলামকে৷ সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে আদালতের নির্দেশে৷ নব্বই-এ সামরিক শাসক এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক যাত্রার যে নতুন পথ শুরু হয়েছিল, তা একবার হোঁচট খায় বিএনপির শাসনামলে ১৫ই ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে৷ তবে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আনলেও এখন তারা এর বিরুদ্ধে৷
বঙ্গবন্ধু বাকশাল এনেছিলেন৷ একদলীয় ব্যবস্থা বলে এর সমালোচনা আছে৷ তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে প্রথমে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে৷ বঙ্গবন্ধু একটি উদারগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য সবাইকে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন৷ সে কারণেই ফৌজদারি মামলা নেই এমন যুদ্ধাপরাধী সাধারণ বন্দিদের ক্ষমা করেছিলেন৷ কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামিদেরও ছেড়ে দেন৷ যুদ্ধাপরাধের হোতা গোলাম আজমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার সুযোগ করে দেন৷ যুদ্ধারাধে ব্যাপকভাবে জড়িত দল জামায়াতকে নিয়ে আসেন রাজনীতিতে৷ এরশাদ পরে ষোলকলা পূর্ন করে দেন৷
এ সব ঘটনা মিলিয়ে দেখলে বাংলাদেশের বর্তমান সংকট বোঝা সহজ হবে৷ এভাবে সংকট কতটা গভীরে তা-ও উপলব্ধি করা যায় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ আর বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই সমাধান খুঁজতে বললেন তাঁরা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু কখনোই আলোচনাকে ‘না' বলেননি৷ এমনকি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও শেষ মুহুর্তে তিনি ছিলেন আলোচনার টেবিলে৷ কিন্তু তিনি কখনোই চেতনাকে জলাঞ্জলি দেননি৷ কথা বলেছেন আর তার মধ্য দিয়ে তাঁর বিশ্বাস, চেতনা এবং রাজনীতিকে পোক্ত করেছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান সংকট নিরসনও হতে পারে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে৷ পথটা হলো, সব দলকে মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাকে সমুন্নত করার প্রশ্নে একমত হতে হবে৷ এই চেতনা ধারণ করতে হবে৷ আর আলোচনা করতে হবে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়৷''
তাঁর মতে, ‘‘বাংলাদেশে এখন যে সংকট চলছে সেটা এককভাবে ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা কোনো সংকট নয়৷ আসলে এটা আরো অনেক বিষয়ের পুঞ্জিভূত রূপ৷ সংকট অসাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িতা৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং এই চেতনাহীনতার৷ একপক্ষ চাইছে যে কোনো উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিদায় করতে৷ যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে৷ আর আরেক দল চাইছে সেটা প্রতিরোধ করতে ক্ষমতা ধরে রাখতে৷ আর তাতে সৃষ্টি হয়েছে অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এর সমাধান আলোচনার মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসবে৷ তবে তা শুধু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করে সম্ভব নয়৷ আগে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারে ঐক্যমত৷ বঙ্গবন্ধুর পথে সমাধান চাইতে হলে আগে তাঁর আদর্শটাকে ধারণ করতে হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু সবসময় বিরুদ্ধ মতকে গুরুত্ব দিতেন৷ কিন্তু আমরা যদি বিরুদ্ধমতকে সম্মান দেখানো বলতে চেতনার বিনাশ বুঝি তাহলে বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে ভুল করব৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের দিকে এগিয়ে গেছেন, সেটাকে সব দল যদি কেন্দ্রে রেখে সংকটের সমাধান খোঁজে, তাহলে সামাধান পওয়া খুব কঠিন হবে না৷ এটা যে এককভাবে আওয়ামী লীগের কাজ, তা নয়, এটা সবদলেরই কাজ৷''
তাঁর মতে, ‘‘এটা সত্য যে বঙ্গবন্ধু সব সময় আলোচনার টেবিলে সমাধান চাইতেন৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশে দুই দলকে আলোচনায় বসিয়ে দিলেই সংকটের সমাধান হবে৷ এখন প্রেক্ষাপট আলাদা, কারণ, সংলাপ বাংলাদেশে একটি স্পর্শকাতর শব্দে পরিণত হয়েছে৷ বিএনপি মনে করছে, সংলাপ মানে হচ্ছে তাদের জয় আর আওয়ামী লীগ মনে করছে সংলাপে বসা মানে তাদের পরাজয়৷ তাই আগে দরকার গ্রাউন্ড ওয়ার্ক৷ পর্দার আড়ালে কথা বলা৷ সেটা মধ্য পর্যায়ের নেতাদের দিয়েও হতে পারে৷ গ্রাউন্ড ওয়ার্ক সফল হলে তখন বোঝা যাবে সংলাপ প্রয়োজন না সংবাদ সম্মেলন প্রয়োজন৷''
শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘‘তবে সবার আগে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে দু'টি বিষয় মানতে হবে৷ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন যে যথার্থ ছিল না তা স্বীকার করা দরকার আওয়ামী লীগের৷ আর বিএনপিকে বলতে হবে আন্দোলনের নামে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা থেকে তারা সরে আসবে৷''
‘‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে যে সংশয় দেখা দিতে পারে তা উড়িয়ে দেয়া যায় না৷ আর ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক৷ দু’পক্ষকেই তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে৷’’ আর সংকট সমাধানের কেন্দ্রে যদি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ থাকে তাহলে ফল আসা খুব কঠিন হবে না বলে মনে করেন ড. শান্তনু মজুমদার৷