বঙ্গবন্ধু স্মরণে কলকাতা বইমেলায় এক টুকরো বাংলাদেশ
৫ মার্চ ২০২২বাঙালি জাতিকে এক স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন মুজিবুর রহমান৷ হানাদারদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে৷ বাংলাদেশের উদ্ভব ও বঙ্গবন্ধুর জন্মজয়ন্তী এক সূত্রে গেঁথে রয়েছে কলকাতা বইমেলায়৷ এ বার মেলার থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ৷ প্রতি বছরই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য অতিকায় মণ্ডপ থাকে বইমেলায়৷ এ বার তা আরও সুদৃশ্য৷ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের শব্দমালায় সাজানো হয়েছে বাংলাদেশের মণ্ডপ৷ রয়েছে বক্তৃতারত নেতার ছবি৷ মণ্ডপের ভিতর প্রকাশনী সংস্থার সারিবদ্ধ স্টল৷ সুউচ্চ মণ্ডপের শিখর ছুঁয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছবি, কোথাও তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ৷
বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নতুন বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী', ‘কারাগারের রোজনামচা', ‘আমার দেখা নয়া চিন'৷ স্টলে স্টলে রয়েছে পূর্ব প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর বই৷ বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও৷ তাঁকে নিয়ে লেখা একগুচ্ছ বইয়ের সম্ভারও রয়েছে৷ রয়েছে মুজিবুর রহমানকে উত্সর্গ করা লোককবিতা থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ৷ বাংলাদেশ মণ্ডপে হাঁটতে হাঁটতে চোখ আটকে যেতে পারে একঝাঁক সাদাকালো ছবিতে৷ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা পর্যায়ের ছবিতে স্টল সাজিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর৷ সংস্থার পক্ষে মোহাম্মদ সজীব মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঢাকার পাশাপাশি কলকাতাতেও বঙ্গবন্ধুর জন্মের ১০০ বছর উদযাপিত হচ্ছে দেখে ভাল লাগছে৷ আসলে দুই বাংলার মধ্যে ফারাক একটা কাঁটাতারের৷ কলকাতায় এসে মনে হচ্ছে নিজের দেশেই এসেছি৷'' এই সুরই ধ্বনিত হচ্ছে মেলায়৷ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্টলের সামনে বইয়ের প্যাকেট খুলে তাক সাজাচ্ছিলেন মহম্মদ আবুল কালাম আজাদ৷ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঢাকায় বইমেলা চলছে, এখানেও মেলা৷ দুটোকে আলাদা করতে পারি না৷ আমরা বঙ্গবন্ধু স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করেছি৷ ভাল চাহিদা আছে৷''
সজীব-আজাদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ভিড় জমে ওঠে বাংলাদেশ মণ্ডপে৷ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা খুঁজছেন ওপার বাংলার সাহিত্য সমালোচনার গ্রন্থ৷ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের শাহনাওয়াজ আখতারের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী' তুলে নেন অরুণিমা সান্যাল৷ পড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে আমার মামার বাড়ি৷ নাটোরের ছাতনিতে৷ ওই বাংলা সম্পর্কে তাই আগ্রহ একটু বেশি৷ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়তে চাই৷'' সজীব-অরুণিমারা যখন বঙ্গবন্ধুর আবেগকে সম্বল করে বইমেলাকে যথার্থই আন্তর্জাতিক করে তুলছেন, তখন কানে আসে সেই দৃপ্ত কণ্ঠ— ‘এ বারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম'৷ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির স্টল চুম্বকের মতো টেনে নেয় দর্শকদের৷ সেখানে অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে শেখ মুজিবকে, শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে গানে গানে যার ভিডিওয় হাজির মুজিবতনয়া শেখ হাসিনাও৷
এই কলকাতায় আইনের পাঠ নিতে এসেছিলেন তরুণ মুজিব৷ তখন ভারত অখণ্ড, যে স্মৃতি আজ অনেকটাই মলিন৷ সেই আক্ষেপ ঘোচাতে এই শহর, এই বাংলার বঙ্গবন্ধু স্মরণ শুধু বাংলাদেশ মণ্ডপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি৷ মেলার মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানা নিদর্শন৷ হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে বইমেলার লোগো-য় সহাস্য শেখ মুজিব৷ একাধিক প্রবেশদ্বার সেজেছে তাঁর পুস্তকের প্রচ্ছদে৷ লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে ছোট প্রকাশকরা মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত বই সাজিয়ে রেখেছেন৷ মেলায় প্রতি বছর একাধিক প্রকাশক ও পুস্তক বিপণন সংস্থা বাংলাদেশের বই তুলে দেন পাঠকের হাতে৷ সুবর্ণরেখা, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশনের পাশাপাশি কলকাতা বঙ্গবন্ধু পাবলিশিং হাউস নজর কাড়ছে আগ্রহীদের৷ কাচের আড়ালে হুমায়ুন, ইলিয়াস, নির্মলেন্দু, সেলিনার পাশাপাশি এ বার সগৌরব উপস্থিতি শেখ মুজিবের৷
বাংলাদেশ থিম কান্ট্রি হওয়ায় এ বার ৩ ও ৪ মার্চ বাংলাদেশ দিবস উদযাপিত হল বইমেলায়৷ একাধিক আলোচনাসভায় সমৃদ্ধ হয়েছেন দর্শকমণ্ডলী৷ বিষয় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনকথা ও সোনার বাংলার স্বপ্নযাত্রা, শেখ মুজিব থেকে হাসিনা৷ দুই বাংলার বিশিষ্ট গবেষক, ভাষ্যকাররা আলোচনায় অংশ নেন৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেও স্মরণ করছে বইমেলা৷ একটি প্রবেশদ্বারে সাদাকালো ছবিতে উঠে এসেছে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের কীর্তি৷
দুই বাংলার মানুষের মধ্যে সাঁকো সাহিত্য, সংস্কৃতি৷ বইমেলা তার একটা বড় হাতিয়ার৷ এই আদানপ্রদান আরও সহজ করার দাবি বরাবরই উঠেছে৷ বাংলাদেশের প্রকাশকরা এ ব্যাপারে এই বাংলার সহযোগীদের সঙ্গে একমত৷ মওলা ব্রাদার্সের পক্ষে অনুপকুমার দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বইয়ের উপর আমদানি-রফতানি কর বসে৷ ১১ শতাংশ করের ফলে প্রকাশকদের খরচ বেড়ে যায়৷ এটা শেষমেশ পাঠকদেরই বহন করতে হয়৷ আমরা ২০ শতাংশের বেশি ছাড় দিতে পারি না৷'' বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ৫০ বছর পূর্তিতে কি এই প্রতিবন্ধকতা দূর করা যায় না? প্রশ্ন দুই বাংলার বৃহত্তর পাঠক সমাজের৷