ফ্রাঙ্কফুর্টে একুশে আয়োজন
২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯যখন বাংলাদেশে অবস্থিত গোয়েটে ইন্সটিউটে জার্মান ভাষা শিখছিলাম, তখন ‘টানগ্রাম আকটুয়েল' নামের ভাষা শেখার বই-এ যে কতবার এই শহরটার নাম শুনেছি৷ আর মনে মনে ভেবেছি কবে যে যাব এই শহরে! জানবো তার ইতিহাস৷ হ্যাঁ, আমার ভিতর অদম্য কৌতূহল৷ নানা দেশের নানা গল্প আর ইতিহাস জানতে এবং পড়তে ভীষণ ভালবাসি আমি৷
ডয়চে ভেলের রেডিও অফিস জার্মানির বন শহরে৷ তাই আমার কর্মস্থলও বন-এ৷ বনের হয়েসআলে রাস্তায় এই রেডিও অফিস৷ যে মানুষগুলো আমার স্বপ্নের ছিল – যাদের কণ্ঠ শুনতে শুনতে এতদিন ধরে শুধু ভেবেছি, একদিন আমিও এর অংশ হবো৷ ডয়চে ভেলের ফেলোশিপ নিয়ে কাজ করতে এসে তা আংশিক হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে৷ যদিও মানুষের সব স্বপ্নই সত্যি হয়না৷ সব স্বপ্নই সুন্দর হয়না৷ অল্প সময়ের জন্য হলেও জানবো তার ইতিহাস৷ আর কার জন্য কেমন আমি জানি না৷ শুধু জানি, আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের জন্য এটা বিশাল ব্যাপার৷
ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি থেকে নিমন্ত্রণ এল আমার কাছে৷ ২১শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে তারা একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যাচ্ছেন৷ কিন্তু তাদেরকে অনুষ্ঠানটি উদযাপন করতে হবে ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে৷ কারণ ২১শে ফেব্রুয়ারীতে তাঁরা অডিটোরিয়ামের ব্যবস্থা করতে পারেননি৷ কিন্তু নিমন্ত্রণ এলেই তো আর দৌড়ে চলে যাওয়া যায় না৷ তাই ডয়চে ভেলের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান গ্রেহেম লুকাসের কাছে অনুমতি চাইলাম৷ মিললো অনুমতি৷ মনের মধ্যে ছোট্ট টুনটুনি পাখি লাফিয়ে উঠল৷ ডেকে উঠল ‘‘টুন-টুন-টুন''৷ মেঘের দিকে তাকিয়ে বললাম ‘‘এই মেঘ, কোথায় যাও?'' মেঘ উত্তর দিল, ‘‘হেসে'তে''৷ আমি বললাম, ‘‘তাহলে যাওয়ার পথে ফ্রাঙ্কফুর্টকে বলো আমি আসছি''৷
ফ্রাঙ্কফুর্টে যে অনুষ্ঠানটির রিপোর্টটি আমি করতে যাচ্ছি, তা হলো বাংলা থিয়েটারের আয়োজিত মঞ্চ নাটক৷ নাটকের নাম ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল'৷ লিখেছেন, বাংলাদেশের বিখ্যাত নাট্যকার প্রয়াত এস.এম. সোলায়মান৷ নাটক পাগল মানুষ আমি৷ একে তো বাংলা নাটক তার ওপর মঞ্চ নাটক৷ তাও আবার ভিনদেশে মানে ফ্রাঙ্কফুর্টে! নিজের চোখে না দেখলে তো বিশ্বাস করা যায়না৷ বাংলা থিয়েটারের বর্তমান সম্পাদক নুরুল আখন্দ খোকন৷ তিনিই নির্দেশনা দিয়েছেন নাটকটির৷
ফ্রাঙ্কফুর্ট নামতেই বন-এর সাথে যে প্রথম পার্থক্যটি আমার চোখে পড়লো – তা হলো, এখানে অনেক অত্যাধুনিক হাইরাইজ বিল্ডিং বা আকাশচুম্বী অট্টালিকা৷ সুন্দর, কিন্তু অনেক বেশী মানুষের ভীড়৷ প্রথমে পৌঁছালাম নুরুল আখন্দ খোকনের বাসায়৷ সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় তাঁর জার্মান বউ সিল্কের সাথে৷ একটি কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষিকা তিনি৷ বাংলা খুব ভালো বোঝেন৷ জার্মান ছাড়া বাংলা, ইংরেজী এবং জাপানী ভাষায় দক্ষতা তাঁর৷ তাদের সন্তান ৩ বছরের এমিল হুবহু তার মায়ের মতো দেখতে৷ সোনালী চুলের এই বাচ্চাটি এত সুন্দর বাংলা কথা বলে, যেখানে কোন বিদেশী ভাষার টান নেই৷ আমি খুব অবাক হলাম৷ কারণ আমাদের দেশে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চারা যেভাবে কথা বলে তাতে মনে হয় এরা ভিনদেশী, বাংলাদেশী না৷ আর ভীষণ আনন্দিত হলাম এই জেনে যে, সিল্কে ছাত্র জীবনে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের সিটি গাইড হিসেবে কাজ করতেন৷ একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অনুরোধ করলাম, আমাকে শহরটা ঘুরে দেখবার জন্য৷ সিল্কে জানালেন, ফ্রাঙ্কফুর্টে বাঙালী অনুষ্ঠান শুরু হয় সাতটার পর৷ এবং তা চলে রাত বারটা পর্যন্ত৷ তাই পরেরদিন তিনি আমাকে যতটা সম্ভব শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরিয়ে দেখাবেন৷ যদিও পরের দিনই আমি বন-এ ফিরে আসব৷ তারপরও যেটুকু সময় পাব, ঝুলিতে ভরে নেব অভিজ্ঞতা৷ সময় যেন কাটেনা৷ কখন যে আজকের দিনটা পার হবে!
এরপর পৌঁছে গেলাম ফ্রাঙ্কফুর্টের ‘শ্যোনহোফ সালবাউ' মিলনায়তনে৷ সেখানে পরিচয় হয় বসিরুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে ৷ তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট প্রবাসী বাংলা কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক৷ তাঁর কাছে জানতে চাইলাম প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমন্ধে৷ তারা প্রবাসে বাস করেও বাংলাদেশীদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারীকে সম্মান জানাচ্ছে৷ এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে তা জানতে চাইলাম৷ তিনি জানালেন, ‘‘কারণ জন্মগত ভাবে আমি বাংলাদেশী৷ এবং আমার ভাষা বাংলা৷ তাই দেশকে সম্মান জানানোর এরচেয়ে বড় সুযোগ আর নেই৷ তাছাড়া বর্তমানে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক সম্মান এনে দিয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারি৷ এমন একটি দিনকে যদি সম্মান না জানাই তাহলে নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিতে হয়''৷ মনে মনে গাইলাম, ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি''৷
অনুষ্ঠানের শুরু হলো নাটক দিয়ে, নাটক ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল৷' এস. এম. সোলায়মানের এই নাটকটির সারাংশে আমি শুধু এই বলতে পারি, অনেক আগে লেখা এই নাটক এখনো বাংলাদেশের জন্য সত্য ঘটনা৷ এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাচ্ছেন না সম্মান৷ অনুষ্ঠানে ডেকে এনে করা হচ্ছে লাঞ্চিত৷ বাংলাদেশে এখনো দালালদের জবাবদিহিতার কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ মুক্তিযুদ্ধের পর তিন যুগেরও বেশী সময় অতিবাহিত হয়েছে৷ কিন্তু সোনার বাংলা শুধু নামেই রয়ে গেল৷ শিক্ষা এসেছে – আসেনি সুশিক্ষা৷ শিক্ষিত হয়েছে মানুষ কাগজে কলমে৷ স্বশিক্ষার দুয়ার খোলেনি৷ দেশে-বিদেশে যেখানে যাচ্ছে নিজেদের কামড়ে চলছে ৷ কখনো দলের নামে৷ কখনোবা গোত্রের নামে৷ কখনোবা ধর্মের নামে৷ একজন আরেকজন কোথায় সাহায্য করবে, সেখানে নিজেরাই নিজেদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে৷ ব্যতিক্রম যে নেই – তা আমি বলছি না৷ এর মধ্যেও বের হয়ে আসে কিছু মানুষ৷ যারা বয়ে নিয়ে আসে দেশের জন্য সুনাম৷ তখন একসাথে সমগ্র বাংলাদেশ বলে ‘শাবাশ বাংলাদেশ'৷
নাটকের পর শুরু হলো গান, নাচ আর কবিতা৷ বাংলাদেশের বাইরে থেকেও বাংলাদেশের সংস্কৃতির চর্চ্চা৷ যারা জন্মেছে জার্মানিতে৷ কতটুকুই বা জানে তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে৷ কথা যখন বলছে, মনে হচ্ছে ভিনদেশী মানুষের মুখে বাংলা৷ তাকিয়ে দেখি তাদের দিকে আর ভাবি – এরাইতো আমাদের ভবিষ্যৎ৷ অনুষ্ঠানের পিছনের সারিতে মহিলারা তাদের প্রিয় আলোচনা নিয়ে বসেছেন৷ বিষয় শাড়ী গহনা আর কাকে কেমন দেখাচ্ছে৷ হঠাৎ করে অনুষ্ঠান উপস্থাপিকা ঘোষণা দিলেন, এবার নচিকেতার গাওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে'র সাথে নাচতে আসছে দেবারতি মণ্ডল আর সূচনা মণ্ডল আমি বিস্মিত, আমি নির্বাক, আমি আমার মাথা নিচু করে নিলাম৷ পাগলা হাওয়া গানটিকে বলিউড মিক্সিং করে কি অদ্ভুত গান এবং বলিউড নাচ! আসলেই কি এটা বাংলা সংস্কৃতি! অনেকবার শুনেছি লোকমুখে, আজ বুঝলাম ‘‘আজ রবীন্দ্রনাথ থাকলে...'' এবং আজ আমি তা বিশ্বাস করলাম৷ আমার শুধু বলার আছে – ‘‘রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আমার৷ কিন্তু এই সংস্কৃতি আমার না৷ আপনারা আপনাদের সন্তানদের বাংলাদেশের সত্যিকার সংস্কৃতি এবং ইতিহাস জানান৷ অবশ্যই তারা জার্মানিতে থাকবে এবং এদের সংস্কৃতি শিখবে৷ কিন্তু নিজেদের দেশের সংস্কৃতিকে ছোট করে নয়৷''
অনুষ্ঠান শেষে আমি ঘুরছিলাম ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল' নাটকের নির্দেশক নুরুল আখন্দের পিছনে৷ একটা সাক্ষাৎকারের জন্য৷ তিনি জানালেন, পরের দিন মানে ১৫ই ফেব্রুয়ারীতে আমাকে সাক্ষাৎকার দিবেন তিনি৷ শিল্পীর এই ইচ্ছা শিরোধার্য৷ নাটকে যারা অভিনেতা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে, তারা হলেন: রাশেদ, আরব, ওমর ফারুক, দীপন এবং নুরুল আখন্দ খোকন নিজে৷ মাত্র তিনজন অভিনেতা আর বাকি দুজন সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন৷ এক কথায় অপূর্ব চিন্তা-ধারা এবং অসামান্য অভিনয় শৈলী সঙ্গে চমৎকার সূর মিলিয়ে দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছে৷
পরেরদিন আমার অনেক কাজ৷ ঘুরে দেখতে হবে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের কিছু ঐতিহ্য৷ জানতে হবে অনেক কিছু৷ যদি হাতে সময় কম তারপরেও একটি সাক্ষাৎকার নিতে হবে নুরুল আখন্দ খোকনের৷ তাই সেদিনের মতো নিজেকে বিশ্রাম দিলাম৷