প্রোটিয়াদের বাগে পেয়েও সুযোগ হাতছাড়া
১০ জুন ২০২৪'ভিনদেশী তারা' গানে অনিন্দ্য বন্দোপাধ্যায় জানতে চেয়েছেন, ' তোমার কিসের এত তাড়া'। বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটা দেখে থাকলে হয়তো অনিন্দ্য বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাছে জানতে চাইতেন তাদের ফেরার এত তাড়া কেন? নিউ ইয়র্ক থেকে সেন্ট ভিনসেন্টের ফ্লাইট তো আরো দিন তিনেক পর। কোথাও তহবিল সংগ্রহে যেতে হবে নাকি দর্শনীর বিনিময়ে নৈশভোজে? মাত্র ১১৪ রান তাড়ায় বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং এই প্রশ্নটাই জাগিয়ে তোলে মগজে।
নিউ ইয়র্কে সোমবারের সকাল মানেই মনখারাপের শুরু। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। ইংরেজিতে একটা কথাই আছে ‘মানডে ব্লুজ', যার মানে হচ্ছে সপ্তাহের শুরুতে কাজে যাবার ভয়। অথচ সেসব ‘ব্লু‘ ছাপিয়ে সোমবার সকালটা লাল-সবুজে রাঙিয়ে দিলেন বাংলাদেশের পেসাররা। বিশেষ করে তানজিম হাসান সাকিব আর তাসকিন আহমেদ। টসে হেরে বোলিং পেয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত, যদিও জানিয়েছেন জিতলে আগে বোলিংই নিতেন। নতুন বল হাতে শুরুটা তানজিম হাসান সাকিবের। ডট দিয়ে শুরু, পরের বলে ছয় এবং তারপরের বলে চার। মনে হচ্ছিল নিউ ইয়র্কের উইকেটের জুজু সব উধাও, আরও একবার কুইন্টন ডি ককের ব্যাট চওড়া হবে বাংলাদেশকে পেয়ে। হলো না। হতে দিলেন না সাকিব। প্রথম ওভারের শেষ বলে রেজা হেনড্রিকসকে এলবিডাব্লিউ করলেন, নিজের পরের ওভারে এসে ভেঙে দিলেন ডি ককের স্টাম্প। পুল করতে চেয়েছিলেন ডি কক, বলটা মিস করলেন। খুব সম্ভবত একটু নিচু হয়েছিল বলটা আর গিয়ে আঘাত করলো অফস্টাম্পের মাথায়। ২ ছক্কা আর ১ চারের সাময়িক ঝড় তুলে ডি ককের বিদায়। ম্যাচের পরের ওভারে তাসকিন আহমেদ ভাংলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক এইডেন মার্করামের (৮) স্টাম্প আর তানজিম সাকিব নিজের পরের ওভারে ফিরে এসে বোল্ড করলেন ট্রিস্টান স্টাবসকে (০)। ২৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে প্রোটিয়ারা যেন তখন থরথর করে কাঁপছে।
উদ্ধারকর্তা হয়ে এলেন হেনরিখ ক্লাসেন আর ডেভিড মিলার। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে তারা চার-ছক্কার বন্যা বইয়ে দেন, বিশাল বিশাল সব ছক্কা মারেন। দুজনেই আশ্চর্য রকম নীরব বাংলাদেশের বিপক্ষে। ক্লাসেন তবুও রিশাদ হোসেনের একটা ওভারে আগ্রাসী হয়েছিলেন, তবে এরপর আর কখনো বড় ঝুঁকি নিতে দেখা যায়নি তাকে। পঞ্চম উইকেটে ৭৯ বলে ৭৯ রানের জুটি দুজনের, যেটা ভেঙেছে তাসকিনের বলে ৪৬ রান করা ক্লাসেনের স্টাম্প ছত্রখান হয়ে যাওয়ায়। মিলারের ৩৮ বলে ২৯ রানের ইনিংস তো 'মিলার দ্য কিলার' নামের সঙ্গে একদমই বেমানান। অবশ্য বহু আগেই খরচা হয়ে যেতে পারতেন মিলার, ১১তম ওভারে মাহমুদউল্লাহ'র প্রথম বলেই থিক আউটসাইড এজে ক্যাচ দিয়েছিলেন মিলার। বল লাগে উইকেটের পেছনে থাকা লিটনের উরুতে, তালুবন্দি করতে না পারায় বেঁচে যান ১৩ রানে থাকা এই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান।
২০ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ১১৩ রান দক্ষিণ আফ্রিকার। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে ৪ ওভারে মাত্র ১৮ রান খরচায় ৩ উইকেট তানজিম সাকিবের। জোড়া শিকার তাসকিন আহমেদের। ১ উইকেট নিয়েছেন রিশাদ। সাকিব আল হাসান বল করেছেন মাত্র ১ ওভার, ৬ রানে কোনো উইকেট পাননি।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের গল্পটা চন্দ্রবিন্দুর গানের কথার মতোই, ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার ব্যস্ততা দেখলে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করবে, ‘‘তোমার কিসের এত তাড়া?'‘ তানজিদ তামিম কাগিসো রাবাদার ওভারে প্রথম দুই বলেই চার মেরেছেন, ৮ রান চলে এসেছে তারপরও শেষ বলটায় অফস্টাম্পের বাইরে তাড়া করে মারতে গেলেন। ব্যাটের কানায় লেগে বল উইকেটরক্ষকের হাতে। সেই শব্দ সবাই শুনেছেন, তামিম শুনতে পাননি। রিভিউ নিতে চাইলেও দেননি অধিনায়ক শান্ত। পাওয়ার প্লে শেষ, ইনিংসে প্রথমবারের মতো স্পিনার আক্রমণে এনেছেন মার্করাম। বামহাতি স্পিনার কেশব মহারাজের প্রথম বলটাই ইনসাইড-আউট খেলতে গিয়ে তুলে দিলেন মিলারের হাতে। বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজলভ্য যে বোলার, সেটা বামহাতি স্পিনার। আর সেই বামহাতি স্পিনারকেই প্রথম বলে এভাবে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হওয়াটা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সাকিব আক্ষরিক অর্থেই বোধহয় আইনরিখ নরকিয়ার শর্ট বলটা চোখে দেখেননি, যেভাবে পুল করতে গিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিলেন আনাড়ির মতো তাতে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে ব্যাট হাতে তার চর্চার অভাবের ব্যপারটা। শান্তও আউট হয়েছেন অনেকটা একইভাবে। ১৪৬ কিলোমিটার গতির বলে হুক করতে গিয়ে বল হাওয়া ভাসিয়ে দিয়েছেন।
এই অস্থিরমতিদের ভিড়ে স্বস্তি দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ আর তাওহিদ হৃদয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও এই দুজনের ব্যাটেই জয়ের দিশা পেয়েছিল বাংলাদেশ, প্রোটিয়াদের বিপক্ষেও এই দুজনের ৪৫ বলে ৪৪ রানের জুটিটাই ম্যাচে রাখে বাংলাদেশকে। কাগিসো রাবাদার বলে ১৮তম ওভারের শুরুতেই হৃদয় লেগবিফোর উইকেটের শিকার হয়ে বিদায় নেন ৩৭ রান করে, তখন থেকেই বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা কমতে শুরু করে। জাকের আলি অনিক এসে বাউন্ডারি মারতে পারছিলেন না , অথচ ম্যাচে এই রকম মুহূর্তে দ্রুত রান তোলার জন্যই তাকে একাদশে নেয়া। হৃদয় আউট হওয়ার পর আর কোনো বাউন্ডারি পায়নি বাংলাদেশ।
শেষ ওভারে বাংলাদেশের জয়ের জন্য চাই ১১ রান। মার্করাম বল দিলেন কেশব মহারাজকে। ওয়াইডে শুরু, তারপর ডাবলস নিলেন মাহমুদউল্লাহ, এরপর সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন জাকের আলিকে। বলটা চালিয়ে খেলে লং অনে তুলে বিদায় নিলেন ৯ বলে ৮ রানের ইনিংস খেলে যা দলের চাহিদার সঙ্গে একদমই বেমানান। রিশাদ নতুন ব্যাটসম্যান, এসে সিঙ্গেল নিয়ে দিলেন মাহমুদউল্লাহকে। শেষ ২ বলে ৬ রান লাগে, মাহমুদউল্লাহ স্ট্রাইকে। ফুলটস বলটায় ব্যাট চালিয়েছিলেন সর্বশক্তিতে, হাওয়ায় ভেসে প্রায় সীমানা পেরিয়ে চলেই যাচ্ছিল বলটা। মার্করামের অসাধারণ এক ক্যাচে শেষ মুহূর্তে বলটা আটকে গেল মার্করামের হাতে, অবিশ্বাসে মাথায় হাত মাহমুদউল্লাহ'র। শেষ বলটাও ফুলটস দিয়েছিলেন মহারাজ, কিন্তু সেটা কাজে লাগানোর মত যে কেউ আর নেই। ১ রান হল, তাতে হারের ব্যবধান কমে হল ৪।
পেসারদের দারুণ শুরুর পর অল্পতেই প্রোটিয়াদের বেঁধে রাখা এবং জয়ের সম্ভাবনা, সবেতেই জল ঢেলে দিয়েছেন বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। বিশেষ করে লিটন, তামিম, শান্ত এবং সাকিব তারা প্রত্যেকেই এই হারে সমানভাবে দায়ী। পাওয়ার প্লেতে একটু ভাল শুরু, টপ অর্ডারে ছোট একটা জুটি বদলে দিতে পারত ম্যাচে বাংলাদেশের ভাগ্য। তখন হয়তো টানা ২ ম্যাচ জিতে গ্রুপে শীর্ষেই থাকত বাংলাদেশ, নিশ্চিত হত দ্বিতীয় পর্বে খেলা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর : সাউথ আফ্রিকা ১১৩/৬; ক্লাসেন ৪৬, মিলার ২৯; তানজিম সাকিব ৩/১৮
বাংলাদেশ-১০৯/৭ ; হৃদয় ৩৭, মাহমুদউল্লাহ ২০; মহারাজ ৩/২৭
ফল : দক্ষিণ আফ্রিকা ৪ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা : হেনরিখ ক্লাসেন