রাইন উপত্যকা
১৮ নভেম্বর ২০১২ইতিহাসের পাতা খুঁজলে দেখা যায়, রাইন ও দানিউব – এই দুটি নদী ছিল রোমান সাম্রাজ্যের উত্তর সীমানা৷ আর তখন থেকেই নদীপথ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রাইন৷ ভূমিকা রেখেছে সামরিক প্রতিরক্ষা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণেও, যা রাইন নদীর দু'পাশের অসংখ্য দুর্গ, প্রাসাদ ও প্রাচীন প্রতিরক্ষা স্থাপনার নিদর্শন থেকেই বোঝা যায়৷
বিঙেন থেকে কোবলেনৎস'এর পথে কঠিন শিলা আর ঢালু আঙুরখেত ঢেকে রাখে এই রাইন নদীর দু'তীর৷ দু'পাশে ছোট ছোট, সুন্দর সুন্দর শহর আর অতীতের ধ্বংসাবশেষ৷
তাই প্রতি বছর প্রায় দু'কোটি পর্যটক আসেন রাইন ভ্যালি দেখতে৷ ভালোবাসেন বোটে চড়ে রাইনের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে৷ পর্যটকদের ভাষায়, ‘‘ছোট ছোট বসতি, পাহাড়ে আঙুরের খেত, রাইন নদীর দৃশ্য – সব মিলিয়ে এটাকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে ফেলা চলে৷''
অথবা, ‘‘জায়গাটা খুবই সুন্দর৷ এই সব পুরনো দুর্গ দেখতে ভারী ভালো লাগে৷ সত্যিই বেড়ানোর মতো জায়গা৷ আমরা দেখে মুগ্ধ হয়েছি৷''
মধ্য রাইন উপত্যকার মতো এত বেশি দুর্গ পৃথিবীর আর কোথাও নেই৷ আর এগুলোর অধিকাংশই বানানো হয়েছে দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতকের মধ্যে৷ যেমন রাইনের বাম তীরে রাইনস্টাইন দুর্গ৷ ৯০ মিটার উঁচু একটা পাথরের টিলার ওপর দাঁড়িয়ে এটি৷
রাইনস্টাইনও মধ্যযুগের দুর্গ, যা বহুদিন ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে ছিল৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটাকে আবার সারানো হয়৷ দুর্গের মালিক মার্কুস হেশার জানান, ‘‘ত্রয়োদশ শতকে এই দুর্গের কাহিনি শুরু৷ মাইনৎস'এর আর্চবিশপের আমলে এখানে শুল্ক আদায় করা হতো৷ ঊনবিংশ শতকে প্রাশিয়ার এক রাজপুত্র দুর্গটি কেনেন এবং তাঁর গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন৷ এটা ছিল তাঁর স্বপ্ন, তাঁর আমোদপ্রমোদের জায়গা৷''
রাইনস্টাইন দুর্গে দেখার মতো অনেক জিনিস আছে৷ এই যেমন বহু পুরনো কাঠের আসবাব, একেবারে মধ্যযুগ থেকে রোম্যান্টিক আমল অবধি৷ তার সঙ্গে রং করা কাঁচের জানলা৷ এক কথায় অপূর্ব!
রাইনস্টাইন দুর্গের মাত্র দশ কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত বাখারাখ৷ শোনা যায়, মধ্যযুগীয় এই শহরটিতে কাঠ ও সুরার ব্যবসা ছিল৷ তবে বাখারাখের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতীকচিহ্নটি হলো ‘ভ্যার্নার চ্যাপেল' নামক ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি গির্জার ধ্বংসাবশেষ৷ তবে মধ্য রাইন উপত্যকার যে জিনিসটি বিশ্ব বিখ্যাত, সেটা হলো সেখানকার ‘ওয়াইন'৷
এই অঞ্চলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দেখা যায় আঙুরখেত৷ এর থেকেই ওয়াইন তৈরি করা হয়৷ আর সেটা সেই রোমানদের আমল থেকেই৷ ১৭০০ বছর আগে তারা রাইন উপত্যকায় আঙুরের চাষ শুরু করে৷ বর্তমানে মধ্য রাইন এলাকায় ওয়াইন প্রস্তুতকারীদের মধ্যে ফ্রিডরিশ বাস্টিয়ানের নাম উল্লেখ না করলেই নয়৷ রাইনের মাঝখানে হাইলিগেন ভ্যার্ট নামের একটি দ্বীপে তাঁর দুই হেক্টারের আঙুরখেত আছে৷
দ্বীপটির ‘রিজলিং' ওয়াইনটির বিশেষত্ব হলো তার তাজা, টক স্বাদ এবং পাকা ফলের মতো সুগন্ধ৷ ফ্রিডরিশ বাস্টিয়ানের নিজের কথায়, ‘‘এখানকার ওয়াইন তৈরির এলাকাটা অপেক্ষাকৃত ছোট, মাত্র ৪৪০ হেক্টার৷ কিন্তু এলাকাটা রাইন নদীর প্রায় ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে৷ এর ফলে, এক এক জায়গার ওয়াইনের স্বাদ এক এক রকম৷ যেমন বাখারাখের ওয়াইনের স্বাদ বেশ ধাতব৷ কিন্তু এর কয়েক কিলোমিটার পরের তৈরি ওয়াইনের অনেক বেশি সুগন্ধ৷''
এরপর, নদী বেয়ে আরো দশ কিলোমিটার গেলে চোখে পড়বে বিশ্ববিখ্যাত লোরেলাই রক৷ রাইন থেকে ১২৫ মিটার খাড়া হয়ে উঠে গেছে এই পাহাড়৷ কিংবদন্তি বলে, লোরেলাই নামের এক সুন্দরী নাকি এই পাহাড় থেকে গান গেয়ে মাল্লাদের মন ভোলাতেন আর তাঁদের নৌকা জলের তলার পাথরে ধাক্কা খেয়ে ডুবতো৷
অবশ্য আজও লোরেলাই পাহাড়টি মধ্য রাইন উপত্যকার দৃশ্য দেখার একটি আদর্শ স্থান৷ স্বাভাবিকভাবেই, অঞ্চলটি পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল৷ সেখানকার স্থানীয় জেলা পরিষদের সভাপতি গ্যুন্টার ক্যার্ন বলেন, ‘‘আমাদের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য হলো, আমরা রাইন উপত্যকায় গতি কমাতে চাই৷ আমরা চাই যে গাড়িচালক আর সাইক্লিস্টরা এখানে নামুন, থাকুন, কিছুটা সময় কাটান৷ আমরা প্রকল্পটির নাম দিয়েছি ‘রাইনব্লিক', অর্থাৎ রাইন দর্শন৷ আমরা বহু থামবার জায়গা সৃষ্টি করবো, যেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে রাইন পর্যন্ত নামা যাবে৷ সেখানে বসে, এক পাত্র ওয়াইন হাতে রাইনের দৃশ্য উপভোগ করুন৷''
তবে মধ্য রাইন উপত্যকা পায়ে হেঁটে ঘোরা কিংবা ট্রেকিং করার পক্ষেও আদর্শ৷ বহু পায়ে হাঁটার পথ আছে এখানে....আর সে পথ ধরে পায়ে হেঁটে কোবলেনৎস শহর পর্যন্তও যাওয়া যায়৷ সেখানেই মোজেল নদী এসে রাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে রাইন উপত্যকার উত্তরাংশ: ৬৭ কিলোমিটার জুড়ে এক অপরূপ অভিজ্ঞতা৷