প্রাণের মেলা একুশে বইমেলা
৩০ জানুয়ারি ২০১৭বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ‘বইমেলার ইতিহাস ও নতুন আঙ্গিকে বইমেলা' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন৷ সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা সাহেব যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা'-র আয়োজন সম্পন্ন করেন৷ কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু'জন ছাত্র নিহত হয়৷ ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি৷ ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়৷ এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে৷''
২০১৪ সাল থেকে এই বইমেলা বর্ধমান হাউজ থেকে সম্প্রসারিত হয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বিস্তৃত হয়৷ এই মুহূর্তে প্রকাশকদের স্টলগুলো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেই স্থান দেয়া হয়েছে৷ আর বর্ধমান হাউজ এলাকায় লিটল ম্যাগ, মিডিয়া এবং বাংলা একাডেমিসহ অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়৷ সব মিলিয়ে এখন তিন শতাধিক প্রকাশকের প্রায় চারশ' স্টল থাকে মেলায়৷ অন্যসব বইমেলা প্রকাশকরা করলেও একমাত্র ব্যতিক্রম হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা৷ এটা বরাবরই বাংলা একাডেমি আয়োজন করে আসছে৷
১৯৮৪ সালের আগেও এই বইমেলার কিছু ধারাবাহিকতা আছে৷ ১৯৬৫ সালে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের তখনকার পরিচালক, কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন তখনকার পাবলিক লাইব্রেরিতে (এখন ঢাকা বিশ্বদ্যালয় লাইব্রেরি) শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন, যাকে ঢাকার প্রথম বইমেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ তারপর ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রথম একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলারও আয়োজন করা হয়েছিল৷
শামসুজ্জামান খান তাঁর প্রবন্ধে আরো লিখেছেন, ‘‘ওই বছর বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন৷ তাঁর দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাঁদের বই নিয়ে বসে যান৷ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন৷ সে উপলক্ষ্যে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান৷''
সেই মেলা, এই মেলা
গত বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে, বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৪৪৪টি৷ এছাড়া একাডেমির নজরুল মঞ্চ ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যান অংশে মোট ৫৩৫টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে৷ আর বই বিক্রি হয়েছে মোট ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকার৷
২০১৪ সালের বইমেলায় মোট ১৬ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে৷ মেলার পরিসর ও প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়, ২০১৫ সালে তুলনায় ২০১৬ সালে প্রায় দ্বিগুণ বই বিক্রি হয়৷ মেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের চাহিদা থাকে সব সময়ই৷ গত বছর মেলায় বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নসহ বিভিন্ন স্টল ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকে একাডেমির বিক্রিত বইয়ের পরিমাণ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা৷ ২০১৫ সালে ১ কোটি ৫৮ লাখ এবং ২০১৪ সালে ১ কোটি ১৮ লাখ ঢাকার বই বিক্রি করেছে বাংলা একাডেমি৷''
বইমেলা প্রাঙ্গনের মোট আয়তন চার লাখ ৭৮ হাজার বর্গফুট৷ গত বছর মেলায় ৬৫১টি ইউনিটে মোট ৪০১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন অংশ নেয়৷ এর মধ্যে প্যাভিলিয়ন ১৫টি, চার ইউনিটের স্টল ১৯টি, তিন ইউনিটের স্টল ৩৭টি, দুই ইউনিটের স্টল ১৩৪টি ও এক ইউনিটের স্টল ছিল ১৯৬টি৷ এর বাইরে বহেরা তলায় ছিল লিটল ম্যাগের ৯০টি স্টল৷ এবারও আয়োজন একইরকম বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ৷
আলোচিত শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই বইমেলা এখন সৃজনশীল প্রকাশকদের বই প্রকাশের প্রধান টার্গেট৷ এই মেলাকে কেন্দ্র করেই সারা বছরের শতকরা ৯০ ভাগ সৃজনশীল বই প্রকাশ হয়৷ তাই আমরা মেলার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি৷ এবারও চার শতাধিক প্রকাশক প্রায় চার হাজার বই প্রকাশ করবেন বলে আশা করছি৷''
তিনি জানান, ‘‘এটা প্রকাশকদের মেলা নয়, বাংলা একাডেমির মেলা৷ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস, ঐাতহ্য৷ তাই এই মেলার একটা ভিন্ন মাত্রা আছে৷ এটা আমাদের জাতীয় ঐহিত্য৷''
রবিন আহসান আরো জানান, ‘‘এই মেলায় শুধু বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার বই থাকে৷ বিদেশি ভাষা বা বিদেশি প্রকাশকদের এখানে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই৷''
তরুণ এই প্রকাশক জানান, ‘‘বইমেলায় নতুন বই আসে, নতুন লেখকরাও আত্মপ্রকাশ করেন৷ আর পাঠকরা নেন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ৷ এবার আমি কমপক্ষে ৩০টি নতুন বই নিয়ে আসছি৷ এর মধ্যে নতুন লেখকদের বইও আছে৷''
প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমির একটি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় এ বছর শ্রাবণ প্রকাশনীকে মেলায় স্টল বরাদ্দ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একাডেমি কর্তৃপক্ষ৷ শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদের মুখে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে শ্রাবণ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়৷ এ প্রসঙ্গে রবিন আহসান বলেন, ‘‘বইমেলা হলো মুক্তবুদ্ধির মেলা৷ এখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এগিয়ে যাবেই৷''
প্রাণের মেলা
‘‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের প্রাণের মেলা'' বললেন কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই মেলাকে সামনে রেখেই অধিকাংশ লেখক তাঁদের লেখা তৈরি করেন৷ তাছাড়া প্রবীণের সঙ্গে নতুন অনেক লেখকেরও আবির্ভাব হয়৷''
সেলিনা হোসেন বলেন, ‘‘এই মেলা পাঠক সৃষ্টি করে পাঠক ধরে রাখে৷ ডিজিটাল এই যুগেও বইমেলার আকর্ষণে পাঠকরা ছুটে আসেন, নতুন বই ছুঁয়ে দেখেন, কেনেন৷ নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হন তাঁরা৷ এই মেলা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষে অনেক বড় ভূমিকা রেখে আসছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘শিশুদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে এই মেলার বড় ভূমিকা আছে৷ মেলায় চালু করা হয়েছে শিশুপ্রহর, অর্থাত শিশুদের বইয়ের জন্য আদালা চত্বর৷''
সেলিনা হোসেন বাংলা একাডেমি পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য৷ তাই বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে৷ তিনি জানান, ‘‘বাংলা একাডেমি রাত-দিন কাজ করছে এই মেলাকে সফল করতে৷ এর নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য সবদিক নিয়ে কাজ করছেন তারা৷''
এবার বইমেলায় নতুন লেখক হিসেবে প্রথম বই নিয়ে আসছেন সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বইমেলায় আমি আমার প্রথম বই নিয়ে আসছি কয়েকটি কারণে৷ এই মেলায় পাঠকের সবচেয়ে বড় সমাবেশ ঘটে৷ এই মেলাতেই পাঠকরা নতুন লেখকদের বই খোঁজেন৷ তাই পাঠকের কাছে পৌঁছানোর এর চেয়ে সহজ পথ আর নেই৷ বিজ্ঞাপন লাগে না, প্রচার লাগে না৷ ভালো বই হলে পাঠক লুফে নেন৷''
নিরাপত্তা
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সম্প্রসারণের পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে, বইমেলা চলাকালে মেলা থেকে বের হওয়ার পর জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়৷ এর আগে ২০০৪ সালে বইমেলার বাইরে হামলার শিকার হন প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ৷ পরে তিনি জার্মানিতে মারা যান৷ রবিন আহসান বলেন, ‘‘বইমেলার ভিতরের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংকট নাই৷ তবে বাইরের নিরাপত্তা আরো বাড়ানো দরকার৷''
বইমেলার নিরাপত্তা পরিকল্পনা সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বইমেলার প্রতিটি গেটে ডিজিটাল নিরাপত্তা তল্লাশির ব্যবস্থা থাকবে৷ মেলার ভিতরে এবং বাইরে থাকবে পর্যাপ্ত সিসি টিভি ক্যামেরা৷ মেলায় সার্বক্ষণিক আমাদের নিয়ন্ত্রণকক্ষ কাজ করবে৷ বাইরে উঁচু ভবন থেকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে বরাবারের মতো৷ আমরা মেলা এবং মেলার বাইরে আশেপাশের এলাকা নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলব৷''
জানা গেছে, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার আওতায় থাকবে বইমেলা প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান৷ বিভিন্ন পয়েন্টে থাকবে র্যাব ও পুলিশের চেকপোস্ট৷
এর বাইরে বইমেলায় পাইরেসি, নকল বই বা মেলার নীতিমালা ভঙ্গ কেউ করছেন কিনা তা দেখতে একাডেমির আলাদা টিম কাজ করবে আগের মতোই৷
বইমেলা শুধু বইমেলা নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে আয়োজন করা হয় ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিভিত্তিক আলোচনা সভা এবং অনুষ্ঠান৷ তাতে বিদেশি লেখকরাও অংশ নেন৷ এছাড়া এই মেলা চলাকালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়৷ বরাবরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী ১ ফেব্রুয়ারি মেলার উদ্বোধন করবেন বলে খবর৷
বন্ধ, আপনি কি বইমেলা যাবেন? কার বই আপনার সবচেয়ে প্রিয় লিখুন নীচের ঘরে৷