ড. ইউনূসকে হয়রানির বিপরীতে বিচারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩তবে সরকারের তরফ থেকে বারবার ফিরে আসছে একই বক্তব্য৷ বলা হচ্ছে, ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে মন্তব্য একেবারেই বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের শামিল৷
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্কের বিবৃতির জবাবে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, "ড. ইউনূসকে কোনো হয়রানি করা হচ্ছে না। যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা মামলার করেছেন। এ ধরনের বক্তব্য বাইরে থেকে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে আমি মনে করছি।”
ড. ইউনূসের মামলা প্রসঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের বিবৃতি সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে কিনা জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা নিয়ে সরকার কোনো চাপ অনুভব করছে না।”
এর আগে বিশ্বের ১০০ জন নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ বিশিষ্টজন ড.ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেন। তারা মামলার কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানান। এবার জাতিসংঘের মানবাধিকার ইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন,"অধ্যাপক ইউনূস প্রায় এক দশক ধরে হয়রানি ও ভয়ভীতির মুখোমুখি। তিনি বর্তমানে দুটি বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন যেগুলোতে তার কারাদণ্ড হতে পারে। একটি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং দ্বিতীয়টি দুর্নীতির অভিযোগ।” তিনি বলেন, "আমরা উদ্বিগ্ন যে তার বিরুদ্ধে মানহানিকর প্রচারণা অনেক সময়ই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আসছে এবং এতে তার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার ঝুঁকি আছে।”
আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে আসা বিবৃতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের একাংশ এরই মধ্যে অবস্থান নিয়েছেন৷ বিবৃতি দিয়ে তারা বলছেন, ওই ধরনের বিবৃতি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থারও ওপর হস্তক্ষেপ।
ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন শ্রম আইনে কলকারখানা অধিদপ্তরের মামলা এবং দুদকের মামলা উচ্চ আদালতে চলছে। নিম্ন আদালতেও নতুন ১৮টি মামলা হয়েছে। সবমিলিয়ে তার বিরুদ্ধে এখন মামলা ১৯৮টি। শ্রম আইনে ফৌজদারী মামলা করার কোনো কারণ নেই । বড়জোর সিভিল মামলা হতে পারতো। আর দুদকের মামলাটি ফানি একটি মামলা। তাকে যে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত করে মামলা করা হয়েছে, তার সঙ্গে কোনো দূরতম সম্পর্ক তার নেই।”
তার দাবি, "এই দুইটি মামলা সরাসরি সরকারের করা, যারা তাকে অপছন্দ করেন, যারা তাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিদায় করার পর এখন তার সামাজিক ব্যবসাকে ধ্বংস করতে চায়, তারাই এইসব মামলা করে তাকে বিচারিক হয়রানি করছেন। ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় একটি মহল ঈর্ষান্বিত। তারাই এখন তিনি যাতে আর বড় কোনো অর্জন করতে না পারেন, সেই চেষ্টায় তাকে হয়রানি করছেন। আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, তার সামাজিক ব্যবসার অর্থ লুটপাট করা।”
ড. ইউনূসের আইনজীবীর এসব বক্তব্যের জবাবে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম বলেন," ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা কাগজপত্রের ডকুমেন্টের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এখানে কোনো আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি একজন নোবেল লরিয়েট, এখন লবিস্ট নিয়োগ করে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এইসব বিবৃতি দেওয়াচ্ছেন। আর ট্যাক্সের মামলা তো তিনি নিজেই করেছেন। পরে সেই টাকা দিয়ে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছেন।”
তার কথা, "এইসব বিবৃতির পিছনে ভূরাজনৈতিক কারণ আছে। আমি জানি, এখন আমাকে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে ফলো করা হচ্ছে। তবে সরকারের দিক থেকে আমার ওপর কোনো চাপ নেই। সরকারের ওপর কোনো চাপ আছে কিনা আমি জানি না।”
সরকারের শেষ সময়ে এইসব মামলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আগেই বিভিন্ন সময় এই মামলা হয়েছে। বিচারে আসতে নানা পর্যায় অতিক্রম করার সময় লাগে।”
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, "বাংলাদেশেই তো নাগরিকদের একাংশ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন তুলছে। আমার মনে হয় না আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে যারা ড. ইউনূসের ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছেন, তারা আবেগের বশে দিয়েছেন। তারা তথ্য-প্রমাণ নিয়েই কথা বলছেন।”
তার কথা, "ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শ্রমিকদের টাকা তিনি যদি মেরে থাকেন, তিনি কি একা মেরেছেন? আর কেউ মারেনি? তাদের বিরুদ্ধে তো মামলা হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, "এখানে সরকারের প্রতিষ্ঠানের মামলা আছে। আর ক্রিমিনাল মামলা তো পুলিশ করে। এখন সরকারে দায়িত্ব হলো ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো যে সঠিক তা প্রমাণ করা।”
আর সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, "আমাদের এখানে সরকার অনেক ক্ষেত্রেই বিচার ব্যবস্থা বা বিচারিক প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের সখ্য নেই। তাকে হয়রানির জন্য মামলা নিঃসন্দেহে একটা মাধ্যম হিসবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
তার কথা, "দুর্নীতি দমন কমিশনের রেকর্ড যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন ক্ষমতাধর কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা নেই। তাহলে কি ক্ষমতাধররা কোনো দুর্নীতি করে না? বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ১০০ মামলা চলমান আছে। বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা আছে। এর মধ্যে গায়েবি মামলাও আছে। এই ক্ষেত্রে প্রফেসর ইউনূসকে সরকার যে কারণেই হোক বন্ধুভাবাপন্ন মনে করে না। তার বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থা প্রয়োগ করে তাকে হেনস্থা করবে এটা খুবই সম্ভব। এবং এটাই বাস্তবে হচ্ছে।”
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, "ড. ইউনূসকে হয়রানির অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। একটি বিচারধীন বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। তবুও এইটুকু বলছি যে, এই মামলা হয়রানিমূলক নয়। যাদের বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে, তারা আদালতে প্রতিকার চেয়েছে। এটা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এটা তাদের অধিকার। সংবিধানে এই অধিকার তাদের দেয়া আছে। তিনি ( ড. ইউনূস) অপরাধ করেছেন কি করেন নাই সেটা আদালত বিচার করবেন।”
আইনমন্ত্রী বলেন, "আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, তারা এক তরফা শুনে বিবৃতি দিচ্ছেন। আমি মনে করি যে, আমাদের রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীন। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য পরিবেশ করে দেয়া উচিত এবং এটা (বিবৃতি) বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ওপর বাইরে থেকে হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে আমি মনে করি।”
আর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, "ড. ইউনূসকে আমিও সম্মান করি। কিন্তু কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না? এটা কেমন কথা? এটা নিয়ে বাইরে থেকে যে কথা বলা হচ্ছে, বিবৃতি দেয়া হচ্ছে, সেটা সমীচিন বলে আমি মনে করি না।”
তার কথা, "ইউনূসের এই বিষয়টি নিয়ে দেশের ৮০ ভাগ মানুষের কোনো কনসার্ন নেই। কিছু লোক আছে, যারা বিত্তশালী, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তারা এসব করছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এইসব বিবৃতিতে সরকার কোনো চাপ অনুভব করছে না। চাপে থাকার কোনো কারণ নেই।”