প্রতিবাদ জানানো মানেই অপরাধ?
২০ আগস্ট ২০১৮দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷ কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি, কী বিজ্ঞান সবক্ষেত্রেই অবদান রাখা অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি বেরিয়ে এসেছেন এখান থেকে৷ তার চেয়েও বড় কথা, এই বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীরা সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠেন৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে অধিকাংশ ছাত্র আন্দোলনেরই সূতিকাগার এই প্রাঙ্গণ৷এমন ধারণা নিয়েই এসেছিলাম এখানে৷
এখানকার মুক্ত বাতাসে মুক্ত হয়ে বেড়ে উঠব, এমন অনুভূতি খেলা করত সবসময়ই৷ সেই অনুভূতি আরো পোক্ত হলো যখন এসেই দেখি, প্রতিবাদমুখর একদল শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছেন৷ সেটি ছিল শামসুন্নাহার হল আন্দোলন৷ প্রথমে কিছু না বুঝলেও শিরা-উপশিরায় তখন রক্তের বেগ টের পাই৷
প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে গিয়ে কীভাবে সাধারণের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান করা যায়, তা শিখেছি ও করেওছি এখানে৷ সেইসব অনুষ্ঠানের মৌলিক ভাষা ছিল, ছিল মৌলিক আবেদন৷
এসব করতে করতেই একদিন শুনি, বইমেলার বাইরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন ড. হুমায়ুন আজাদ৷ একদিন শুনি, সহপাঠীকে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে ঘাতক বাস৷ আরেকদিন চোখের সামনেই দেখি, বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে বেপরোয়া চালক বাস তুলে দিলেন দুই শিক্ষার্থীকে বহন করা রিক্সায়৷
এসব ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন হাজারো শিক্ষার্থী৷ বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা এই শিক্ষার্থীদের ওপর প্রশাসনের দমনে প্রিয় ক্যাম্পাস হয় রণক্ষেত্র৷ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাতে নিপীড়নের শিকার হতে দেখেছি সহপাঠীদের৷
এতদিন পর যখন আবারো দেখি, নানা ঘটনায় প্রতিবাদ জানাতে শিক্ষার্থীরা মাঠে নামছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের বোধটুকু টের পাই৷
সরকার বদলায়৷ বদলায় না প্রশাসনের আচরণ৷ এখনো দেখি, সেই একই কায়দায় প্রশাসন বা সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের ছেলেরা হামলে পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর৷ এই অপসংস্কৃতি বদলায় না৷ বরং দিন দিন তা আরো ভয়ঙ্কর দানবে পরিণত হয়৷
জনরোষ খুবই স্বাভাবিক বিষয়৷ যে কোনো সমাজেই এই রোষের আশঙ্কা নিয়ত বিদ্যমান৷ জনগণ কোনো কারণে নিজেদের বঞ্চিত ভাবলেই এর উদ্ভব ঘটে৷ তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণকে বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করা৷ তা যখন ঘটবে না, তখন প্রতিবাদ হবে, বিক্ষোভ হবে৷
যে কোনো উত্তেজনা, উসকানি, যা জানমালের জন্য ক্ষতিকর, তা সরকার দমন করবে, সেটাও স্বাভাবিক৷ কিন্তু সেই দমন যখন একতরফা হবে, তখন তা জাতির জন্য বিপজ্জনক৷ বিক্ষোভ বা জনরোষ সামাল দিতে হবে৷ কিন্তু সেই অসন্তোষের মূলেও যেতে হবে৷ সমস্যা চিহ্নিত করে তা জনগণের কল্যাণে সমাধানও করতে হবে৷ যদি তা না করা হয়, সেই রোষ আবারো মাথাচাড়া দেবে৷ একেকবার একেক কায়দায়৷
নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলন কিংবা কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার আপাত সামাল দিতে পেরেছে বটে৷ কিন্তু এসব সমস্যার মূলে যেতে হবে৷
নিরাপদ সড়কের বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার দরকার নেই৷ এর দুষ্টচক্রকে ভাঙতে হবে সরকারকেই৷ তা না হলে আজ কচিমনগুলোতে যে অসন্তোষ, যে ক্ষত তৈরি হলো, তা বয়ে নিয়ে বেড়াবে এই প্রজন্ম৷ সেটা নিশ্চয়ই কারো জন্য ভালো হবে না৷
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর আবারো রাজধানীর রাস্তার প্রায় একই পরিণতি হয়েছে৷ আন্দোলনের পর যেসব উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রুতি সরকার করেছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে৷ তাহলে নিজেদের বঞ্চিত মনে করবে না এই প্রজন্ম৷ আর শুধু আন্দোলন করার জন্য যেসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তাদের ছেড়ে দিতে হবে৷
অন্যদিকে, শ্রমের বা কর্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরো তৎপর হতে হবে৷ যদি তেমন এক পরিবেশ থাকত এ দেশে, আমার ধারণা, কোটা সংস্কারের বিক্ষোভই হতো না৷
আর জনগণ যে কোনো সিস্টেম নিয়ে অসন্তুষ্ট হলে প্রতিবাদ জানাবেই৷ প্রতিবাদ কখনো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়৷