খেলাপি ঋণের পরিমাণ হিসাবের চেয়ে দ্বিগুণ
২ ডিসেম্বর ২০১৯অর্থমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন, শতকরা হারে খেলাপি ঋণ বাড়ছে না৷ কিন্তু তার এই হিসাবকে আমলে নিচেছন না অর্থনীতবিদরা৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেবে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা৷ গত জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা৷ তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা৷ আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা৷ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা৷
গত ১১ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে জানিয়েছিলেন, আজ থেকে এক টাকাও খোলপি ঋণ বাড়বে তো না-ই, উল্টো ধীরে ধীরে কমবে৷’’ তিনি এ নিয়ে ব্যাংকের এমডিদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন বলেও তখন সাংবাদিকদের জানান৷
কিন্তু অর্থমন্ত্রীর ওই কথার পর তার কোনো প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যায়নি৷ জানুয়ারি-মার্চ মাসেই প্রথম বারের মতো খেলাপি ঋণে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়৷ খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়৷ ওই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা৷ পরের তিন মাসে জুন পর্যন্ত বেড়েছে ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা৷
অর্থমন্ত্রী এরপরও বারবার সংসদে দাবি করে আসছেন যে, খেলাপি ঋণ বাড়েনি৷ তিনি এবার এক নতুন ব্যখ্যা হাজির করেছেন৷ তার যুক্তি মোট ঋণের পরিমাণের সঙ্গে তুলনা করলে শতাংশ হারে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি৷ তিনি ১৩ নভেম্বর সংসদে দাবি করেন,‘‘১৯৯১ সালে মোট ১৯ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৩৯ কোটি টাকা৷ তখন খেলাপি ঋণ ছিল মোট ঋণের ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশ৷ এখন মোট ৯ লাখ ৬২ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা৷ শতাংশ হিসেবে তা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৬ ভাগ৷ সেই হিসেবে আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি৷’’
তিনি আরো একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ আর তা হলো,‘‘ব্যাংকের সুদের হার বেশি থাকার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমছে না৷’’
তবে দেশের অর্থনীতিবিদরা অর্থমন্ত্রীর ওই দুই ব্যাখ্যার কোনোটির সাথেই একমত নন৷ বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ‘‘শতকরা হার দিয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে না, এটা বলার কোনো সুযোগ নেই৷ আমরা দেখবো মোট টাকার অংকে দেশে ৯-১০ মাসে আরো ৩০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে৷ আর আমি মনে করি, উচ্চ সুদের হার ব্যাংক ঋণ নেয়াকে নিরুৎসাহিত করে৷ খেলাপি ঋণ আদায়ে এটা বাধা হতে পারে না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এটা সত্য যে, অর্থমন্ত্রী এককভাবে হয়তো চেষ্টা করছেন৷ তার এই চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই৷ কিন্তু তাতে সফল হতে হবে৷ হিসাবের মারপ্যাঁচ করে লাভ নাই৷ আমার মতে, সরকারই এখন বড় ঋণ খেলাপি৷ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে৷ এই ঋণ ফেরত দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করা হোক৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সরকার কোনোভাবেই বড় খেলাপিদের ধরতে পারছে না৷ তারা যে-কোনো একটি সুযোগ তৈরি করে পার পেয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতেই হবে৷ খেলাপি ঋণ আদায় করতেই হবে৷ কারণ, এই ঋণই অর্থনীতিকে এখন সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে৷’’
খেলাপি ঋণের বাংলাদেশ ব্যাংক এখন যে হিসাব দিচ্ছে তা প্রকৃত হিসাব নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সানেম’-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখন খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ১২ ভাগ৷ কিন্তু আইএমএফ গবেষণা করে বলছে, মোট ঋণের ২৫ ভাগ খেলাপি ঋণ৷ তাহলে আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমান যা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার দ্বিগুণেরও বেশি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমি অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যার সাথে একমত না৷ ১৯৯১ সালের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না৷ ২০০৮-২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ৬-৭ ভাগে নেমে এসেছিল৷ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে ব্যাংক খাতে সংস্কারের মাধ্যমে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছিল৷ কিন্তু গত ৮-১০ বছরে পরিস্থিতি আবার খারাপ হয়েছে৷ আর সুদেরহ হার বেশি হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ বেশি, এটা আমি মানতে পারছি না৷ আমার কাছে মনে হয়, খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ার কারণে সুদের হার বেশি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি ঋণ খেলাপির তালিকাটি দেখি, তাহলে দেখব, যারা বড় তারা রাজনৈকিভাবে শক্তিশালী৷ তারা নানা রকমের অন্যায় সুবিধা পেয়েছেন৷ পুনঃতফসিলের নামে তাদের অন্যায় সুবিধা দেয়া হয়েছে৷ ব্যাংকের নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এবং তা ঋণ খেলাপিদের পক্ষেই গেছে৷ কোর ব্যবস্থা তো দূরের কথা, কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি৷ আর ব্যাংক কাঠোমোর দূর্বলতা তাদের সুযোগ করে দিয়েছে৷’’
গত বছর আগস্টের ছবিঘরটি দেখুন...