পূজায় সম্প্রীতির প্রত্যাশা শিল্পী-নির্মাতাদের
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার উদযাপনে সমারোহ কিছুটা কম। দুর্গাপূজার পরিকল্পনা, শৈশব স্মৃতি ও সম্প্রীতির কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন অঙ্গনের শিল্পী-নির্মাতারা। দেখুন ছবিঘরে।
বাপ্পা মজুমদার, সংগীতশিল্পী
পূজায় সাধারণত বনানী মণ্ডপে যাই। এবারও তেমন ইচ্ছেই আছে। আমার মেয়ে অগ্নিমিত্রা মজুমদার পিয়েতার জন্য কেনাকাটা করবো। এখন দায়িত্ব বেশি বলে পূজার উদযাপন কমে গেছে বলে মনে হয়। তখন দায়িত্ব ছিল মৌন, এজন্য মানসিকভাবে উদযাপন বেশি হতো। আনন্দের জায়গাটা এখন অন্যরকম। এবারের পূজায় গণমাধ্যমে বিভিন্ন রকম অনাকাঙ্ক্ষিত খবর দেখছি। এটা খুবই দুঃখজনক। দেশে সম্প্রীতির যে কনসেপ্ট সবসময় ছিল, সেটা যেন অপরিবর্তিত থাকে।
বিদ্যা সিনহা মিম, অভিনেত্রী
এবার ঢাকায় পূজা উদযাপন করছি। আমার মা একটু অসুস্থ। এ কারণে তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও যাচ্ছি না। আশা করি, ভালোই কাটবে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব বাসায় বেড়াতে আসছে। বনানীতে সুন্দরভাবে মন্দির সাজানো হয়েছে দেখলাম। পূজা উপলক্ষে আমাদের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মন্দিরে সাজ সাজ রব। ঢাকার আশেপাশে যেখানে পূজা হচ্ছে সেসব জায়গায় যাবো, ঘুরবো। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে সম্প্রীতির সুবাতাস বয়ে যাক, এটাই প্রার্থনা।
রামেন্দু মজুমদার, নাট্যজন
এবার কিছুটা সংক্ষিপ্তভাবে দুর্গাপূজা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ দেশের পট-পরিবর্তন। নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ধর্মচর্চা করতে হবে, এটা আমার পছন্দ নয়। এমন সমাজ চাই, যেখানে যেকোনও ধর্মের মানুষ নিরাপদে আপন ধর্ম চর্চা করতে পারবে। রাষ্ট্রের আলাদাভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। অতীতেও দেশে পূজায় অপ্রীতিকর ঘটনা দেখেছি। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি দরকার, সমাজের অন্য ধর্মের মানুষদের সহযোগিতা প্রয়োজন।
জ্যোতিকা জ্যোতি, অভিনেত্রী
এবারের পূজায় তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। কোথাও যাচ্ছি না, কেনাকাটাও করছি না। আসলে কোথাও যাওয়ার মতো নিরাপদ বোধ করছি না। যেখানে আছি তার আশেপাশের কোনও মণ্ডপে যাবো কিনা তাও জানি না। এবার বাতাসে পূজার ঘ্রাণ নেই, কেবল বিষণ্নতা ছড়িয়ে আছে। একটা ভয় ও বিষণ্ণতার আবহে এবারের দুর্গাপূজা হচ্ছে। আমার চাওয়া, সব মানুষ নিজের ধর্ম ও উৎসব স্বাধীনভাবে উদযাপন করুক। তাতে যদি বাধা আসে, একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিহত করতে হবে।
মনোজ প্রামাণিক, অভিনেতা
পূজা উপভোগ করতে গ্রামে এসেছি। নওগাঁর নিয়ামতপুর থানায় আমাদের বাড়িতে পূজা উপভোগ করবো। আমি ব্যক্তিগতভাবে শহুরে ও গ্রামীণ পূজায় বিরাট ফারাক দেখেছি। শহরে কেউ কাউকে চেনে না, যে যার মতো মণ্ডপে এসে প্রণাম করে সব দেখে চলে যায়। গ্রামে ঠিক উল্টো। সবাই সবাইকে চিনি, ছোট কমিউনিটি হলেও বন্ধনটা সুদৃঢ়। গ্রামে পূজার সময় ধুপতি নাচের প্রতিযোগিতা, আত্মীয়-স্বজন সবার সঙ্গে দেখা হওয়া, এসব বিষয় ভালো লাগে।
চয়নিকা চৌধুরী, নির্মাতা
ছোটবেলায় ঈদ ও পূজা দুটোই উপভোগ করতাম। অন্য ধর্মের বন্ধুরা পূজা দেখতে আসতো। এমন সুন্দর আবহে বেড়ে ওঠা। আমার ছেলেমেয়েকে এভাবেই মানুষ করেছি। ধর্ম যার যার হতে পারে, কিন্তু উৎসব সবার। সবাই মিলে আনন্দ করার মাঝে আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। পূজার সময় ঢাকার বাইরে সবসময়ই প্রতিমা ভাঙা হয়। এসব দেখলে মন ছোট হয়ে যায়। মন্দির কেন পাহারা দিতে হবে? সবাই বুক ফুলিয়ে চলার মতো নিরাপত্তা চাই।
কিরণ চন্দ্র রায়, লোকজ সংগীতশিল্পী
কৈশোর-তারুণ্যে দুর্গাপূজায় কিছুটা হলেও সাত্ত্বিকতা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে রাজসিক ব্যাপার চোখে পড়েছে বেশি। যতটা জানতে পেরেছি, সব জায়গায় যথারীতি পূজার আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে। হয়তো সমারোহ একটু কম। কয়েক বছরে আলোকসজ্জাসহ বাহ্যিক যেসব বিষয় দেখা গেছে, এবার সেগুলো অর্থনৈতিক কারণে কম। তাছাড়া যেকোনও ঝড়-ঝঞ্ঝায় সংস্কৃতির ওপরেই প্রথম আঘাত আসে। চিত্তে সুখ না থাকলে সংস্কৃতি কিংবা উৎসব উপভোগ করা যায় না।
অনিমেষ আইচ, নির্মাতা
এবারের পূজায় হয়তো একদিন মণ্ডপে যেতে পারি। ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে যেতাম অনেক জায়গায়। একবার এক বন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে আনন্দ-উৎসব উদযাপন করে। নারায়ণগঞ্জ কিংবা পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারে পূজার সময় শুধু হিন্দু নয়, স্থানীয় সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যেই আনন্দ বিরাজ করে। ঈদ এলে আমরাও বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ অসাম্প্রদায়িক।
পূজা সেনগুপ্ত, নৃত্যশিল্পী
এবারের পূজায় আমার মনে সত্যিকার অর্থে কোনও আনন্দ নাই। জুলাই-আগস্টে কত প্রাণ হারালাম আমরা। এরপর বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলো। আমার মনে হয় উৎসবের আনন্দ কারও মনেই নাই। উৎসবের আচারিক দিক হয়তো সবাই রক্ষা করছে। প্রতিবছর পূজা এলে আমরা দেখি কিছু জায়গায় প্রতিমা ভাঙা হচ্ছে। এমন মানসিকতার লোকজন সমাজেই আছে। নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে পূজা-অর্চনা করা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।
মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর
দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় রাতের আঁধারে মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এরমধ্যে রাজশাহীর বাঘা, ফরিদপুর, বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইলের বাসাইল, পাবনা অন্যতম। চট্টগ্রামে মন্দিরে গিয়ে দলবেঁধে ইসলামি সংগীত গাওয়া এবং প্রতিমা পেছনে রেখে মোনাজাত ধরার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে। এসব জায়গায় কর্মরত সাংবাদিকরা ডয়চে ভেলেকে জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।