পুলিশ কখন মারে, কখন মারে না
২৮ জুলাই ২০১৬জার্মানিতে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নিয়ে গত কয়েকমাস ধরেই আলোচনা হচ্ছে৷ বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে পরপর কয়েকটি বড় হামলার পর, জার্মানির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা অনেক বেড়েছে৷ এ রকম অবস্থায় পুলিশের বাড়তি উদ্যোগ থাকা খুবই স্বাভাবিক৷ জার্মান পুলিশ সেই উদ্যোগের আওতায় কয়েক জায়গায় রেইড দিয়েছে, সন্দেহভাজন জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের ধরেও নিয়ে গেছে৷ পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, একটি ক্ষেত্রে সন্দেহভাজনরা যখন বড় এক হামলার পরিকল্পনা করছিল, তখন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ লক্ষ্যনীয় হচ্ছে, এ সব রেইডে কিন্তু কেউ প্রাণ হারায়নি৷
তবে কোথাও সন্ত্রাসী হামলা চলাকালে জার্মান পুলিশের ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়৷ গত ১৮ই জুলাই বাভেরিয়ার ভ্যুয়র্ত্সবুর্গে ট্রেনের মধ্যে এক জঙ্গি কুড়াল দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে কমপক্ষে পাঁচজনকে আহত করে৷ তখন পুলিশের গুলিতে সে নিহত হয়৷ এর কিছুদিন আগে, গত ২৩ জুন, একটি সিনেমা হলে ‘বন্দুক' নিয়ে ঢুকে মানুষকে জিম্মি করার চেষ্টা করে এক ব্যক্তি৷ পুলিশ তাকেও গুলি করে মেরে ফেলে৷
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের রেইডে সন্দেহভাজনরা মারা যায় না জার্মানিতে৷ অন্তত নিকট অতীতে এরকম কোন ঘটনা ঘটেনি৷ এখন কেউ কেউ বলতে পারেন, সাম্প্রতিক পুলিশ রেইডগুলোতে সন্দেহভাজন কেউ মারা না যাওয়ার কারণ তারা পুলিশকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি বা সুযোগ পায়নি৷ এক্ষেত্রে ব্রাসেলসের উদাহরণ টানা যেতে পারে৷ গত বছরের নভেম্বর মাসে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান কমপক্ষে ১৩০ ব্যক্তি৷ কয়েকজন বন্দুকধারী রাতের আধারে তাণ্ডব চালিয়ে তাদের হত্যা করে৷ সেই হামলার মূল সন্দেহভাজন সালাহ আব্দেসালামকে ১৮ই মার্চ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে জীবিত গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় পুলিশ, গুলি বিনিময়ের পর৷ পরপর কয়েকবার ব্রাসেলসের বিভিন্ন স্থানে রেইড দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার সম্ভব হয়েছিল৷
মোদ্দাকথা হচ্ছে, ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে পুলিশের কাছে শেষ অস্ত্র হচ্ছে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়া৷ আর এটা করার ঘটনা বিরল৷ তবে কোনোভাবেই বলছি না যে, বাংলাদেশ পুলিশের উচিত নিজেদের জীবনের বিনিময়ে সন্দেহভাজনদের জীবিত আটক করা৷ পুলিশ নিতান্ত প্রয়োজন মনে করলে গুলি ছুঁড়বে৷ তবে মনে রাখতে হবে, তারা প্রশিক্ষিত৷ কোন পরিস্থিতিতে, কোথায়, কীভাবে, কেন গুলি করতে হবে, কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে, সেটা জানে বলেই তো তারা পুলিশ৷ আর তারা পুলিশ বলেই জনগনের কাছে তাদের দায়বদ্ধতার, জবাবদিহিতার ব্যাপার আছে৷
হতাশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ পুলিশের রেইডে সন্দেহভাজন জঙ্গি, সন্ত্রাসী এবং বিরোধী দলের কর্মীদের নিহত হওয়ার ঘটনা এত বেশি যে এখন পুলিশের হাতে নিহতের কোনো ঘটনা ঘটলেই সেটা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়ে সাধারণ মানুষের মনে৷ সেসব ঘটনার পুলিশি বর্ণনা, আর গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং নিহতদের পরিবারবর্গের বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক খুঁজে পাওয়া যায়৷ ফলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো সহজেই সন্দেহভাজনদের মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের' তালিকায় ফেলে দেয়৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি শুধু বাংলাদেশেই ঘটছে?
প্রতিদিন সকালে ডয়চে ভেলের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগে দিনের কার্যসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়৷ সেই বৈঠকে একদিন ঢাকা পুলিশের কল্যাণপুর অভিযান নিয়ে যখন কথা হয়, তখন তিন বিদেশি সাংবাদিক কয়েকটি উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্ষেত্রে অনেক মিল৷ তাদের হাতে সন্দেহভাজন নিহতের ঘটনা অহরহ ঘটে৷ এটা কি এজন্য যে, পুলিশ মনে করে সন্দেহভাজনদের জীবিত ধরা হলে তারা আইনের ফাঁক থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবারো বড় অপরাধে জড়াতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য পুলিশ কখনো সরাসরি দেয় না৷ তাদের অনানুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রকাশ করাও সাংবাদিকতার নীতিবিরুদ্ধ৷ আবার আদালতে অভিযুক্ত জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা সবাই যে আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়, সেটা বলাও কঠিন৷ বাংলাদেশের দুই শীর্ষ জঙ্গি সিদ্দিকুর রহমান ওরফে ‘বাংলা ভাই’ ও শায়খ আব্দুর রহমানকে কিন্তু ২০০৬ সালে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করে জীবিত উদ্ধারে সক্ষম হয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী৷ পরবর্তীতে আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তিও হয়েছিল৷ আইনের শাসন বজায় রাখতে চাইলে এরকম প্রক্রিয়া অনুসরণের বিকল্প নেই৷
আপনার কি কিছু বলা আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷