রেকর্ড সৃষ্টি
১৬ জুলাই ২০১২ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির নায়কেরা ভাবতেন ৮০ দিনে বিশ্ব ঘুরে রেকর্ড সৃষ্টির কথা৷ বিশেষ করে ফরাসি লেখক জুল ভার্নের লেখা একইনামের বইটি মানুষকে এমন স্বপ্ন দেখতে শেখায় আরো বেশি করে৷ তবে এখন মানুষের রেকর্ড আর ৮০ দিনের মতো দীর্ঘ সময়ের নয়, বরং ধীরে ধীরে তা আরো সংকুচিত হয়ে আসছে৷ গতি এবং দূরত্ব জয় করতে যোগ করা হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি৷ গরম বাতাস দিয়ে চালিত বেলুনে করে পৃথিবী পরিক্রমাও হয়ে গেছে প্রায় দশ বছর আগে৷
এরপর ২০০২ সালের ২রা জুলাই মাত্র ১৩ দিনে বিশ্ব ভ্রমণের রেকর্ড গড়েন স্টিভ ফসেট৷ এছাড়া একইসাথে তাঁর রেকর্ড ছিল বেলুনে করে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিতে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করার৷ প্রথম রেকর্ডের তিন বছর পরই ফসেট আবার রেকর্ড সৃষ্টি করেন স্থির-ডানাওয়ালা বিমান নিয়ে কোথাও না থেমে এবং পুনর্বার জ্বালানি না ভরে এক উড়ালেই সারা বিশ্ব ঘোরার৷ কিন্তু ফসেটের ভাগ্য খুব বেশি সুপ্রসন্ন ছিল না৷ তিনি ২০০৭ সালে যখন আরেকটি রেকর্ড গড়ার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা করেন তখন লাস ভেগাসের মরুভূমিতে তাঁর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে তিনি মারা যান৷
মানুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষকরা বলছেন, ফসেটের ভ্রমণগুলো মানুষের রেকর্ড সৃষ্টির বাসনারই একেকটি উদাহরণ৷ বরফের উপর দিয়ে চাকাবিহীন গাড়ি চালনা থেকে শুরু করে দপ্তরের প্রধানের পদটি গ্রহণ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই শীর্ষ স্থানটি দখল করার ক্রমবর্ধমান বাসনা চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা৷ আর মানুষের উচ্চাকাঙ্খা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট৷
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী পেটার ভালশবুর্গার তাই মানুষের মাঝে আরো উপরে, আরো দ্রুত এবং আরো দূরে যাওয়ার এই আকাঙ্খার কথা জেনে আশ্চর্য হননি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা সবাই অস্তিত্বের লড়াইয়ে বিজয়ীদের বংশধর৷ আর রেকর্ড গড়ার বাসনাটা বিশেষ করে পুরুষদের একটি জিনগত বৈশিষ্ট্য৷'' অন্যদিকে, নারীদের জিনগত ঝোঁক বেশি বাচ্চাদের লালন-পালন, সামাজিক দায়িত্ব পালন এবং টেকসই কর্মকাণ্ডের দিকে৷
ভালশবুর্গার বলেন, মানুষ তার চরম দক্ষতা ও নৈপুণ্য কাজে লাগিয়ে যখন কোন কাজে সাফল্য পায়, তখন চরম আনন্দ উপভোগ করতে পারে৷ আর এটি এমন একটি অনুভূতি যা মানুষ বারবার পেতে চায়৷ সেই প্রবণতা থেকেই মানুষ রেকর্ড গড়ার তাগিদ অনুভব করে৷ ফসেটের মধ্যেও সেই প্রবণতারই বহিপ্রকাশ ঘটেছে৷ তিনি সাঁতার থেকে গাড়ি দৌড়, সমুদ্র যাত্রা থেকে উড়ে বেড়ানোর মতো সকল ক্ষেত্রেই রেকর্ড গড়ার চেষ্টা করেছেন৷
তবে বর্তমান সময়ে রেকর্ড সৃষ্টি শুধু সেরা নৈপুণ্য দেখানোই নয়, বরং সেজন্য দরকার যথেষ্ট প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা৷ এখনকার দিনে সাধারণ মানুষের বিশেষ কোন অর্জন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং একইসাথে সুনাম এবং সৌভাগ্য উভয়ই জোটে৷ ভালশবুর্গার বলেন, ‘‘মানুষের অনেক বড় একটি আকাঙ্খা হলো স্বীকৃতি৷'' গবেষক পেটার ভিপেরমানের মতে, রেকর্ড গড়ার প্রচেষ্টা এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ আর এর পেছনে রয়েছে স্বীকৃতির আকাঙ্খা৷ মানুষের ঝোঁক ও প্রবণতা সম্পর্কে গবেষক ভিপেরমান বলেন, ‘‘কাজের ধরণ যতো ছোট কিংবা বড়োই হোক না কেন, এখন সবার দৃষ্টি হলো নিজের কাজের গুরুত্ব এবং ব়্যাঙ্কিং এর ধারায় শুধু ঊর্ধ্বে ওঠা৷''
তবে বার্লিনের হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ইয়েন্স আসেনডর্ফ মনে করেন না যে, শুধু আনন্দ পাওয়ার জন্য রেকর্ড সৃষ্টির আকাঙ্খা বাড়ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসর সেই প্রাচীন গ্রিসেও ছিল৷ মানুষ যখনই সমর্থ হয়েছে, তখনই খেলাধুলা করেছে৷ তবে তখনকার সাথে বর্তমান সময়ের পার্থক্য হলো এই যে, এখন আধুনিক গণমাধ্যমের বদৌলতে যে কোন রেকর্ডের খবর খুব দ্রুত অধিক সংখ্যক শ্রোতা ও দর্শকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে৷ আর এর ফলে রেকর্ড সৃষ্টিকারীদের জন্য সামাজিক পুরস্কার অনেকগুণ বেড়ে গেছে৷''
তাঁর মতে, ‘‘রেকর্ড সৃষ্টির পেছনে যে চালিকাশক্তি কাজ করে তার কোন পরিবর্তন হয়নি, বরং রেকর্ড সৃষ্টির ফলে প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটেছে৷'' এছাড়া সামাজিক স্বীকৃতির সম্ভাব্যতা বৃদ্ধির ফলে রেকর্ড গড়ার ধাপগুলো আরো নিচু হয়ে এসেছে৷
তবে এখন বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এমন একদিন কি আসবে যখন মানুষ তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাবে এবং রেকর্ড গড়ার আর কোন অবকাশ থাকবে না৷ গবেষকদের অধিকাংশই অবশ্য মনে করছেন যে, এমন কোন আশঙ্কা নেই৷ কারণ রেকর্ড সৃষ্টি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া এবং মানুষের সামনে সবসময় কিছু হুমকি থাকবে এবং নতুন বিধান ও কারিগরি সম্ভাব্যতার সুযোগ থাকবে৷
এএইচ / এসি (ডিপিএ)