পি কে হালদারকে কি ভারত থেকে ফেরত আনা যাবে?
৯ অক্টোবর ২০২৩কিন্তু প্রশ্ন হলো পি কে হালদার যে অর্থ পাচার করেছেন তা কি ফেরত আনা যাবে? আর পি কে হালদারকে কি বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে ভারত?
আদালত পি কে হালদারকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য ১০ বছর এবং পাচারের অপরাধে ১২ বছর এই মোট ২২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে ক্যানাডায় ৮০ কোটি টাকা পাচার এবং ৪২৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি এখন ভারতের কারাগারে আছেন। গত বছরের ১৪ মে ভারতের অশোক নগরে তিনি আটক হন।
পি কে হালদারকে এক হাজার ৪৪ কোটি টাকা জরিমানা এবং তার প্রায় ৬৪ একর জমি, ১১টি গাড়ি এবং এক কোটি কোটি ৮৭ লাখ টাকা জব্দ করার নির্দেশও দিয়েছেন আদালত।
এই মামলায় তার আত্মীয়-স্বজনসহ ১৩ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি দুদক এই মামলাটি দায়ের করে। পি কে হালদার অর্থ আত্মসাৎ এবং অর্থপাচারের মোট ৫২টি মামলার আসামি বলে জানা গেছে। তার মধ্যে এই একটি মামলার রায় হলো।
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে শুরুতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পাচারের কথা বলা হলেও বিভিন্ন মামলার তদন্তে সেটা ১০ হাজার কোটি টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। চারটি নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি এই টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ। ক্যানাডা ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তিনি এই অর্থ পাচার করেছেন। তিনি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। তার দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তাকে আটকাতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর তিনি তার আইনজীবীর মাধ্যমে দেশে এসে আত্মসমর্পণের আবেদন করেছিলেন উচ্চ আদালতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে ফেরেননি।
ক্যানাডায় অর্থপাচারের ঘটনা আদালতে প্রমাণ হলেও পি কে হালদারের পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ এখনো নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন,"বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স চুক্তি আছে। তবে তার সুবিধা পেতে হলে মামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিস্পত্তি হতে হবে। এখন পি কে হালদারের সহযোগী যারা আটক আছেন তারা আপিল করলে এবং তাদের আপিল যদি শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয় তাহলে তো আমরা অর্থ ফেরত আনার কাজ শুরু করতে পরব না। চূড়ান্ত রায় হলে আমরা রায়ের কপিসহ সংশ্লিষ্ট দেশে আবেদন করব। আর অন্য মামলাগুলোতে তো এখনও বিচারিক আদালতের বিচারই শেষ হয়নি।”
দুদকের মানিলন্ডারিং অনুবিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য মতে দুদকের হাতে এখন মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মোট ১১৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৮৩টি মামলার তদন্ত চলছে। ৩২টি মামলায় চার্জশিট ও দুটি মামলায় ফাইনাল রিপোর্টসহ ৩৪টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। তাদের তথ্যমতে মামলাগুলোতে পাচার হওয়া অর্থ সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, হংকং, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
দুদক তাদের মামলায় যে পাচারের অভিযোগ করেছে তার মধ্যে অল্প অর্থই ফেরত আনতে পেরেছে। ২০২০ সালে হাইকোর্টে দাখিল করা দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদক ২০০৯ সালে কাফরুল থানায় করা আরাফাত রহমান কোকোর মামলায় পাচারকৃত প্রায় ২১ কোটি টাকা ফেরত এনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে। ওই বছর ক্যান্টনমেন্ট থানায় এক মামলায় গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা ফেরত এনেছে। ২০১৪ সালে রমনা থানার মামলায় ব্রিটেনে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আট লাখ আট হাজার ৫৩৮ পাউন্ড জব্দ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের গুলশান থানার এক মামলায় মোরশেদ খানের ১৬ মিলিয়ন হংকং ডলার জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১১ সালের ক্যান্টনমেন্ট থানার এক মামলায় গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের চার লাখ ১৮ হাজার ৮৫৩ পাউন্ড জব্দ করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,"পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে আইন আছে। অর্থ ফেরত আনা কিছুটা জটিল হলেও অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। আর এটা শুধু দুদকের একার কাজ নয়, এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরসহ আরো অনেক সংস্থা জড়িত। এর আগে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার নজির আছে।”
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের ব্যবহার করতে হবে বাংলাদেশকে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ নিয়ে আইনি সহায়তা চুক্তি আছে।”
এদিকে ভারত থেকে পি কে হালদারকে ফেরত আনা সেই দেশের মামলা শেষ হওয়ার ওপর নির্ভর করছে বলে দুদক জানিয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে। আর ইন্টারপোলের সহায়তার জন্যও পুলিশ সদর দপ্তরকে বলেছে দুদক। পিকে হালদার বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে ভারতেও বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,"পি কে হালদার ভারতেও অভিযুক্ত । সেখানে আইনগত প্রক্রিয়া চলছে। ফলে এখানে জটিলতা আছে। তবে তার অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে এখনই প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।”
আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন,"পি কে হালদারকে বাংলাদেশ ফেরত আনতে চায় কী না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ তাকে এখানে ফেরত আনা হলে আরও অনেকের নাম প্রকাশ পাবে। তাই তারা তাকে ভারত থেকে ফেরত আনতে হয়তো দেবে না।”
তিনি বলেন,"পি কে হালদারকে তো বাংলাদেশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ভারতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি তো বাংলাদেশের টাকা পাচার করেছেন। তাকে ফেরত আনার আইন আছে। পারস্পরিক চুক্তি আছে। ভারতে দ্রুত আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করে সদিচ্ছা থাকলে তাকে ফেরত আনা যায়।”