পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফেরা বিষয়ে নাগরিক ভাবনা
পাহাড়ে শান্তি আনতে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি হয়েছিল৷ কিন্তু এখনও মাঝেমধ্যে পাহাড় অশান্ত হয়ে ওঠে৷
‘আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে’
মানবাধিকার কর্মী ইলিরা দেওয়ান বলেন, পাহাড়ে শান্তি না ফেরার অন্যতম কারণ পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া৷ চুক্তি সইয়ের সময় উভয় পক্ষের মধ্যে কিছু অলিখিত চুক্তিও হয়েছিল, যেগুলির কোনোটিই আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৫ বছরে বাস্তবায়ন না করে পাহাড়ি জনগণের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে৷ পাহাড়ে বৈষম্য হ্রাসে এখনও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বলেও মনে করেন তিনি৷
মনমানসিকতার পরিবর্তন আনা উচিত’
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো: নবীর উদদীন বলেন, শান্তি চুক্তির সব গুলো ধারা বাস্তবায়ন না করার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে৷ তাছাড়া আমাদের মনে রাখা উচিত, আমরা যেমন বাংলাদেশি তেমনি পাহাড়িরাও বাংলাদেশের নাগরিক৷ তারাও পাহাড়ে বসবাস করতে পারবেন৷ আমাদের সকলের মনমানসিকতার পরিবর্তন আনা উচিত৷ তাহলেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে৷
‘ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি আইন হয়েছে, বিধিমালা হয়নি’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘‘চুক্তির পর আমরা চেয়েছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করতে সরকার উদ্যোগ নেবে৷ চুক্তি হলো, আইন হলো৷ ভূমি কমিশনও করা হলো৷ কমিশনের কাজ ছিল ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করা৷ ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন করা হলো৷ এর বয়স ২৭ বছর৷ কিন্তু এ আইনটি কার্যকর করতে এখনো বিধিমালা করা হয়নি৷’’
‘পারস্পরিক বন্ধুত্বের বিশ্বাস তৈরি করা দরকার’
কবি হাসান রোবায়েত বলেন, ‘‘পাহাড় কেবল আমাদের কাছে রোমান্টিসিজমে ভরা একটি বিষয়৷ কিন্তু পাহাড়িদের স্ট্রাগল সম্ভবত আমরা কম মানুষই রিয়েলাইজ করি৷ আমি মনে করি পাহাড়ের আদিবাসীরা বাংলাদেশের অর্নামেন্ট৷ তাদের স্বতন্ত্র জীবনযাপনের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত৷ পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্বের বিশ্বাস তৈরি করা দরকার৷
‘মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব আছে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রিয়াসী চাকমা বলেন, আদিবাসীদের শুধু সাংবিধানিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে তা নয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যেভাবে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে তাতে মনস্তাত্ত্বিকভাবেও বিচ্ছিন্ন করে দেখার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে৷ ৷ তারা শিক্ষিত হওয়ার পরও উত্তেজনা সৃষ্টির মতো কাজে কন্ট্রিবিউট করে যাচ্ছেন, সাথে কিছু মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব তো আছেই৷
‘নৈতিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে’
আলোকচিত্রী সুমন পাল বলেন, ‘‘আমার মনে হয় বৈষম্য দূর করার জন্য সমাজের মানুষের মানসিকতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং নৈতিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে৷ আজকে পাহাড়ে যে আন্দোলন হচ্ছে তাতো আজকের নতুন ঘটনা না, সেতো চলমান এবং আন্দোলনের যৌক্তিকতা চিন্তা করে সবার সাথে বসে শান্তির পথে আসাটাও জরুরি৷’’
‘রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব’
শিক্ষার্থী ও অ্যাক্টিভিস্ট পদ্মিনী চাকমা মনে করেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব এবং দীর্ঘমেয়াদী অবহেলা এই প্রক্রিয়াকে ধীর করে দিয়েছে৷ জাতীয় রাজনীতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার কথা বেশিরভাগ সময় কেন্দ্রীয় আলোচনার বাইরে থাকে৷ বাংলাদেশ রাষ্ট্র আদিবাসী মানুষদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার স্বীকার করতে চায় না৷
‘সংবেদনশীল মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করেনি’
বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতা দনওয়াই ম্রো বলেন, পাহাড়ে শান্তি না ফেরার কারণ রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক যৌক্তিক দাবি-দাওয়াগুলোকে কোনোবারই সংবেদনশীল মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করেনি৷ উন্নয়ন, সন্ত্রাস দমনের নাম করে শক্তি প্রয়োগের পথ পরিহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনীতির সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঠিক করার আহ্বান জানান তিনি৷
পক্ষপাতমূলক আচরণ সংঘাত বাড়ায় তোলে’
নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সফটওয়্যার ডেভেলপার জয় ধন চাকমা বলেন, পাহাড়িদের মধ্যে একটি ধারণা আছে যে, সংঘাতের পেছনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মদদ রয়েছে৷ পাহাড়িদের অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতিতে অপরাধের সাথে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও অনেক নিরীহ পাহাড়ি জনগণকে আটক করে, অথচ বাঙালি পক্ষ থেকে কাউকে ধরার ঘটনা খুবই কম৷ পক্ষপাতমূলক আচরণ সংঘাত বাড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷