পার্টির গঠনতন্ত্রই পড়েন না তারা
১৮ অক্টোবর ২০১৯স্কুলে পড়ার সময় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট করা এক বন্ধুর সঙ্গে ‘ভ্যানগার্ড' পত্রিকা বেঁচতে গিয়ে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে আমার পরিচয়৷
এরপর তাদের পার্টি অফিসে যাওয়া আসা৷ পরে ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেকের সঙ্গে পরিচয়৷
রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কিংবা সরকারি বেসরকারি অফিসগুলোতে ঢুকে পত্রিকা বিক্রি করতাম৷ এই যৎসামান্য টাকা দিয়ে পার্টির খরচ, কনভেনশন এসব আয়োজন করা হতো৷ একদম গরীবী ব্যাপার৷ কিন্তু এটাই কেন যেন আমার মধ্যবিত্ত মনোজগতকে আকর্ষণ করত৷ মনে হতো, এটাই হওয়া উচিত৷ কিছু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করবেন, অন্যরা সেজন্য পয়সা দেবেন৷ তাই ছোটবেলায় আমার পরিচিত রাজনীতি ছিল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ৷
এই মডেলটিই পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা গুটিকয়েক মানুষ প্রয়োগ করলাম৷ এক বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে ‘নতুন গানের উৎসব' নামের একটি জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান করলাম৷ চাইলেই দু'একটি স্পন্সর ম্যানেজ করতে পারতাম৷ কিন্তু আমরা ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী' অবস্থান নিয়ে জনগণের ওপর আস্থা রাখলাম৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কখনো ডাকসুর সামনে, কখনো টিএসসিতে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে চলতে লাগল টাকা সংগ্রহ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এলেন৷ যে যা পারেন, দুই টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা দিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন৷
মৌলিক গানের প্লাটফর্ম নতুন গানের উৎসব সফলভাবে করার পর আমরা পরের বছর করলাম নির্মাণ মেলা এবং তারপরের বছর কনসার্ট ফর ফাইটার্স৷ টিএসসি সড়কদ্বীপে কনসার্ট ফর ফাইটার্সের মঞ্চে গান গাইতে এলেন দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরী৷ তিনি গাইলেন, ‘‘আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমি অন্তরের কথা বলতে চাই৷'' গাইতে গাইতে কথাও বলতে লাগলেন৷ একসময় বললেন, ‘কর্ণেল তাহেরকে খুন করেছেন কে?' তখন বিএনপির আমল৷ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা পাশেই হাকিম চত্বরে বসা৷ উপস্থিত শত শত শিক্ষার্থীর মুখ দিয়ে জোর গলায় বের হয়ে এল ‘জিয়া'! তখন ছাত্রদলের নেতারা ক্ষেপে গেলেন৷ আয়োজকদের ওপর চাপ দিলেন যেন সঞ্জীবদা নেমে যান৷ যদিও পুরো পারফরম্যান্স শেষ করেই নেমেছিলেন তিনি৷ এই হলো ছাত্র রাজনীতি- চাপ প্রয়োগ, পেশীশক্তির প্রদর্শন৷ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতার ওপর আঘাত, যদি তা সরকার দলের বিপক্ষে যায়৷ একই ঘটনা ঘটল আবরারের ক্ষেত্রেও৷ বলা হচ্ছে, সরকারের বিপক্ষে যায় এমন কথা ফেসবুকে লেখার জন্য তাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে মেরে ফেললেন৷ কী ভয়ঙ্কর!
আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নতুন এক বন্ধু হলো৷ জানালেন, তিনি তার এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে, তিনি রাজনীতি করবেন না, পয়সা কামাবেন আর ঐ বন্ধু রাজনীতি করবেন৷ ঐ বন্ধুর পয়সার চাহিদা তিনি মেটাবেন৷
সমস্যা হলো, এমন ‘আদর্শিক' রাজনীতি কেবল বামপন্থিদের মাঝেই দেখেছি, যদিও বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনীতি কখনোই বড় জায়গা করে নিতে পারেনি৷ সেটার কারণ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে৷ কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার একটা সংস্কৃতি এখনো সেখানে আছে৷ কিন্তু ডানপন্থিদের মধ্যে কি আদর্শ নেই? অবশ্যই আছে৷ কিন্তু দলের অধিকাংশ কর্মী দলের গঠনতন্ত্রই ঠিকমত পড়েন না৷ আত্মস্থ করা তো দূরের কথা৷ তাই দলের আদর্শ শুধু মুখের বুলি ছাড়া আর কিছু নয়৷
শিক্ষার্থীরা বিদ্যাপীঠে কীসের রাজনীতি করবে? তারা রাজনীতি করবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া পূরণ হচ্ছে কি না, তাদের থাকার যথেষ্ট জায়গা আছে কি না, বেতন ভাতা ইত্যাদি আয়ত্তের মধ্যে আছে কি না, লাইব্রেরি আছে কি না, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বইপত্তর আছে কি না, ল্যাব আধুনিক কি না, এসব নিয়ে৷
কিন্তু বাস্তবে দেখেছি, রাজনীতি হয়, কাকে হলে তোলা হবে, কাকে হবে না, কাকে কোন রুমে তোলা হবে, ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া, আশেপাশের এলাকা থেকে চাঁদা তোলা, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি নিয়ে৷ আরো আছে৷ কার বাড়ি কুমিল্লা, কার বাড়ি বরিশাল, রংপুর বা কুড়িগ্রাম এসব নিয়ে রাজনীতি হয়৷ যেন একটি ছোট্ট দেশের মধ্যে আরো অনেক দেশ!
ছাত্রলীগের আজকের অবস্থার পেছনে এই সংস্কৃতি দায়ী, যে সংস্কৃতির দায় শুধু ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের নয়৷ কিন্তু ছাত্রলীগ যে জন্য নিন্দিত, সেই একই কারণে পুরো আওয়ামী লীগও নিন্দিত৷ একই কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি নিন্দিত৷ তাই ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে গেছে, এই যুক্তিতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া উচিত, এই যুক্তি খুব খারাপ যুক্তি৷
কিন্তু ছাত্রলীগেরটা বেশি দেখা যায়, কারণ তাদের ভুলগুলো অপরিণত, অপরিপক্ক৷ আরো কারণ আছে৷ ছাত্রছাত্রীরা যে জায়গায় রাজনীতি করে, সেই বিদ্যাপীঠগুলো অনেক বেশি সচেতন প্রাঙ্গন৷ এখানে কোনো কিছু করলে সেটা কখনো চাপা থাকে না৷ তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক বেশি সক্রিয়৷ তারওপর দেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ নাগরিক তরুণ৷ আর মানুষের আগ্রহের জায়গাও এখানে, ভরসার জায়গাও৷ একটি উদাহরণ দিয়ে বলি, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে নিয়মিত প্রতি চার-ছয়মাসে একবার রক্ত দিতাম৷ একবার এক নারীকে দেখলাম মধুর ক্যান্টিনের সামনে অসহায় দাঁড়িয়ে৷ তার বাচ্চা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি৷ রক্ত দরকার৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এখানে কেমন করে এসেছেন?'' তিনি বললেন, ‘‘আমার এক চাচা বলেছেন, কোথাও না পাওয়া গেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবে৷''
এই যে মানুষের আস্থার জায়গা, এটা একদিনে তৈরি হয়নি৷ ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনে বারবার প্রমাণ করেছেন যে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়৷ আমি তাই আজও আস্থা রাখছি৷ সব ছাত্রছাত্রীর ওপর রাখছি৷ ছাত্রলীগের ওপরও রাখছি৷ তবে আজ কঠিন পরীক্ষার মুখে এই ছাত্রসংগঠনটি৷ ক্ষমতার অপব্যবহারের সবরকমের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে৷ সাধারণ মানুষ আর তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না৷ এখান থেকে তারা ফিরতে পারবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না৷
কিন্তু বদলাতে হবে আমাদেরও৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোর হতে হলে, ছাত্র রাজনীতি নয় বরং ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া বন্ধ করতে হবে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা এর আশেপাশে কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যদি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে মিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মানবিক আচরণ শেখাতে হবে৷ বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সব উদাহরণ আছে৷
ছাত্র রাজনীতির এক কঠিন খারাপ সময় যাচ্ছে৷ এর থেকে একে বের করে আনতে হবে৷ একদিনে কিছুই হবে না৷ কিন্তু দেশের প্রয়োজনে সংস্কৃতির সংস্কার প্রয়োজন৷ সময় লাগলেও, কঠিন হলেও, সে পথেই হাঁটতে হবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷