পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে, কী লাভ কৃষক-শ্রমিকের?
২২ অক্টোবর ২০২২দশকের পর দশক ধরে ধুঁকছে পাটকলগুলো। বয়নশিল্পের আধুনিকীকরণ ও বিকল্প কৃত্রিম সামগ্রী বাজারে আসায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে পাটজাত সামগ্রী। চটের ব্যাগের চাহিদা কমেছে। তাই ক্রমশ রুগ্ণ হয়ে পড়েছে এই শিল্প। শিল্পের পুনরুজ্জীবন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শিল্প রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই।
তবে সংকটের পরিস্থিতি থেকে পাটশিল্পকে উদ্ধারের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার ফলে প্রাকৃতিক পণ্য, উপাদানের দিকে অনেকেরই আগ্রহ বাড়ছে। এর ফলে বহুজাতিক বিভিন্ন সংস্থা পাটজাত সামগ্রী ব্যবহারের দিকে জোর দিচ্ছে। প্লাস্টিকের সামগ্রী পরিবেশের ক্ষতি করে, দূষণ ছড়ায়। তাই সংস্থাগুলির লক্ষ্য পাটের থলি বা অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানো যাতে পরিবেশ রক্ষা পায়। এর ফলে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের পাটশিল্পের মরা গাঙে জোয়ার আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে।
বিদেশে বাড়ছে চাহিদা
ওয়ালমার্ট, স্পেনসার, ক্যারেফুর, টেসকোর মতো বহুজাতিক সংস্থা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তাদের ব্যবসা ছড়িয়েছে। এই বিপণিগুলিতে যে ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে চটের তৈরি পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রীর উপর তারা জোর দিচ্ছে। একইসঙ্গে প্যাকিংয়ের জন্য চটের কাপড়ের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে।
ভারতের ন্যাশনাল জুট বোর্ডের হিসেবে, ২০২০-২০২১ সালে দেশটি ভারতীয় টাকায় দুই হাজার ৭৪০ কোটি টাকার পাটজাতপণ্য রপ্তানি করে৷ তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০২০ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪২৩ কোটি টাকা৷
এদিকে ভারতীয় চটকল সংগঠনের সূত্র থেকে পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, বহুজাতিক সংস্থাগুলি ভারতীয় টাকায় এক হাজার কোটি টাকার চটের ব্যাগ কিনেছে গত বছরে। এর সঙ্গে যদি প্যাকিংয়ে প্রয়োজনীয় চটের পাতলা কাপড়সহ অন্যান্য সামগ্রী যুক্ত করা হয়, তাহলে ওই অংক সাড়ে তিন হাজার কোটিরও বেশি।
তবে এই হিসেব সমগ্র ভারতের নিরিখে হলেও পাটশিল্প বলতে মূলত পশ্চিমবঙ্গকেই বোঝায়। কারণ দেশের ৯৩টি চটকলের মধ্যে ৭০টির মতো রয়েছে এ রাজ্যে। বিদেশে পাটজাত যে সামগ্রী রপ্তানি হয়, তার ৮০ শতাংশের উৎপাদন হয় পশ্চিমবঙ্গে। ২০২১ সালে হাজার কোটির যে ব্যাগ রপ্তানি হয়েছে, সেই অংক ২০১৬ সালে ছিল মাত্র সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ভারতের সবচেয়ে বড় বাজার। সেদেশে রপ্তানি গত বছর ২৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮২০ কোটি টাকা।
নদীর পাড়ে আশা
এমন পরিসংখ্যান স্বপ্ন দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের চটশিল্পীদের। হুগলি নদীর দুই পাড়ে ধুঁকতে থাকা একের পর এক চটকলে কি দীপাবলির আগেই আশার আলো জ্বলে উঠল? এখানকার শ্রমিকদের একটা বড় অংশ বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা অবাঙালি জনতা। তারা বছরের পর বছর, বংশ পরম্পরায় এ রাজ্যেই থেকে গিয়েছেন। প্লাস্টিকের দাপটে পাট শিল্পের মন্দা, যখন তখন মিলে লকআউটের ফলে এই শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ।
হুগলির তেলিনীপাড়ার চটকল শ্রমিক সুকেশ মিশ্র, বিকাশ যাদবরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যদি পাটের জিনিসের চাহিদা বাড়ে, তাহলে মিল ভাল চলবে, এর বেশি আমরা আর কী বলব! সবকিছুর দাম এতো বেড়েছে যে সারা বছর মিল চালু না থাকলে সংসার চালানো যায় না।”
আশাবাদী চটকল সংগঠন
ইন্ডিয়ান জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের শীর্ষ কর্তা রাঘবেন্দ্র গুপ্তার মন্তব্য, "প্রাকৃতিক জিনিসই এখন ফ্যাশনের সামগ্রী হয়ে উঠছে। আর চটের থেকে বেশি পরিবেশবান্ধব কী হতে পারে?”
রাজ্যের প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী, সিপিএম নেতা অনাদিকুমার সাহু রপ্তানি ও চাহিদা বৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এতে পাটশিল্পের উপকার হবে। চাষি থেকে শ্রমিক, চাহিদা বাড়লে সকলেরই সুবিধা হওয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে প্রশাসনকেও দেখতে হবে যাতে বাণিজ্যের সুফল থেকে এরা বঞ্চিত না হন।”
কৃষক-শ্রমিকের কী লাভ?
সংশয়ের রেশ থেকে যাচ্ছে সুখবরের আবহেও। পাটচাষি ও চটকলের শ্রমিক কতটা লাভবান হবেন? অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রতন খাসনবিশ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পাটজাত সামগ্রীর চাহিদা বাড়লেও এদেশে চটকল শ্রমিকদের মজুরি খুবই কম। অস্থায়ী শ্রমিকদের অন্য কোনো সুবিধাও নেই। জুট কর্পোরেশন কাঁচা পাটের দাম নির্ধারণ করলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে কৃষকরা দাম পান না। তাই পাটের ব্যবসা বাড়লে লাভ হবে চটকল মালিক আর ফড়েদের। কৃষক-শ্রমিককে এর সুফল দিতে গেলে সরকারকে আরো তৎপর হতে হবে।”