পাকিস্তানের ঈশ্বরনিন্দা আইন
৭ নভেম্বর ২০১৪সম্প্রতি তার আরো একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল৷ জেলহাজতে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তি মহানবি'র সাহাবিদের অপমান করেছেন, এই দায়ে এক পুলিশকর্মী তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে৷ ঘটনাটি ঘটেছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরাট শহরে৷ পুলিশ দাবি করছে, হত্যাকারীর নাকি মানসিক ভারসাম্যের অভাব ছিল৷ অপরদিকে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত থেকে বিশেষ কোনো লাভ হবে না, বলেই ধরে নেওয়া যায়৷
এর মাত্র কয়েক দিন আগের ঘটনা: স্থানীয় এক মসজিদ এক খ্রিস্টান শ্রমিক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোরআন অপবিত্র করার অভিযোগ আনার পর, উত্তেজিত জনতা তাদের পিটিয়ে মারে এবং মৃতদেহগুলি ইটভাটায় পুড়িয়ে ফেলে৷ মহিলা আবার সন্তানসম্ভবা ছিলেন৷ নিহতদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খুব সম্ভবত ভুয়া ছিল৷ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নওয়াজ শরিফ এই ঘটনার নিন্দা করলেও, ঈশ্বরনিন্দা আইন সংশোধন করার মতো ক্ষমতা বা অভিপ্রায়, দু'টোর কোনোটাই তাঁর নেই৷ সে ধরনের উচ্চাশা যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা তিনি জানেন: ২০১১ সালে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি'কে তালেবানের হাতে প্রাণ দিতে হয় ঠিক ঐ উচ্চাশার কারণে৷
পাকিস্তানের ঈশ্বরনিন্দা আইন চালু হয় ব্রিটিশ আমলে৷ আশির দশকে জেনারেল জিয়া-উল-হক সে আইনকে আরো জোরদার করেন৷ বলতে কি, জিয়ার সংস্কারের কারণেই পাকিস্তানে যে কোনো ধর্মীয় ইস্যুতে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তোলা আজও এতোটা সহজ৷ জিয়ার পেনাল কোড অনুযায়ী যে কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে ঈশ্বরনিন্দাই দণ্ডনীয়, কিন্তু বাস্তবে সেটা যারা ইসলাম ধর্মের অপমান করছে বলে মনে করা হচ্ছে, শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়৷ সেই সঙ্গে আছে বিচার পদ্ধতি: মাত্র একজন সাক্ষী থাকলেই চলে; সাক্ষ্য প্রকাশ করার নিয়ম নেই, কেননা তার ফলে আবার ঈশ্বরনিন্দা ঘটবে৷ উকিলরা আসামি পক্ষের মামলা নিতে ভয় পান, কেননা তাদের নিজেদের খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে৷
কাজেই এই ঈশ্বরনিন্দা আইন এখন ঘৃণা, প্রতিশোধ কিংবা সম্পত্তি দখলের মতলব, সব স্বার্থ হাসিল করার জন্যই ব্যবহৃত হয়ে থাকে - বিশেষ করে আহমদিয়া মুসলমান, খ্রিস্টান কিংবা হিন্দুদের বিরুদ্ধে৷ অতি সম্প্রতি পাঁচ সন্তানের জননী এক খ্রিস্টান মহিলা - যার ২০১০ সালে ফাঁসিতে ঝোলার কথা ছিল - সেই আসিয়া বিবি'র মৃত্যুদণ্ড রদের আপিল আবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে৷ বিবি'র ঘটনাটা ঈশ্বরনিন্দা আইনের কঠোরতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়: আসিয়া বিবি অন্যান্য মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে ফল তোলার সময় একই পাত্র থেকে জল খেয়েছিলেন, যা কিনা ঈশ্বরনিন্দার সমতুল৷ পাঞ্জাব প্রদেশের রাজ্যপাল সালমান তাসির আসিয়া বিবি'র পক্ষ সমর্থন করার দায়ে তাঁর এক দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন - সেটা ছিল ২০১১ সালের ঘটনা৷
মোট কথা, জিয়া-উল-হক পাকিস্তান'কে যে পথে নিয়ে গেছেন, সেখান থেকে ফেরা অতোটা সহজ হবে না৷ চরমপন্থি ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুগামীরা জনজীবনকে এমনভাবে নিজেদের কব্জায় নিয়ে এসেছে যে, তাদের ক্ষমতাকে সীমিত করার শক্তি বর্তমান প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতাদের নেই৷ তবে পশ্চিমি দেশগুলি তাদের উষ্মা ও সমালোচনা জ্ঞাপন করতে পারে বৈকি: যেমন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যখন একটি রাষ্ট্রীয় সফরে এই সপ্তাহান্তে বার্লিনে পদার্পণ করবেন৷