1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গের সিভিক ভল্যান্টিয়ারের নিয়োগ কতটা রাজনৈতিক

১৬ অক্টোবর ২০২৪

আরজি কর মামলার শুনানিতে সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্টেও সমালোচিত হয়েছে সিভিক-নিয়োগ।

https://p.dw.com/p/4lrCQ
আরজি করে পুলিশ পোস্টিং
আরজি করের বাইরে পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীছবি: Subrata Goswami/DW

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ রাজ্যের কাছে একটি হলফনামা চেয়েছে। সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের কীভাবে নিয়োগ করা হয়, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, তাদের বেতন দেওয়া হয় কীভাবে এবং তাদের কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, এই সবকিছু আগামী শুনানিতে জানাতে হবে রাজ্যকে। প্রধান বিচারপতি নির্দেশে বলেছেন, হাসপাতাল, স্কুলের মতো সংবেদনশীল জায়গায় সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়োগ হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের সেখানে নিয়োগ করা হচ্ছে না, একথা জানাতে হবে রাজ্যকে।

এখানেই শেষ নয়, এবিষয়ে শুানি চলাকালীন আদালত প্রশ্ন তুলেছে, সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের নিয়োগ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট কি না!

এই সমস্ত প্রশ্ন উঠছে কারণ, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ধর্ষণ ও খুন মামলায় যে প্রধান অভিযুক্ত, সে একজন সিভিক ভল্যান্টিয়ার। নাম সঞ্জয় রায়। কীভাবে হাসপাতাল তার অবাধ আনাগোনা ছিল, সে প্রশ্ন বার বার সামনে এসেছে।

কে সঞ্জয় রায়?

আদালতের শুনানিতে নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী, নিয়োগের সময় সিভিক ভল্যআন্টিয়ারদের অতীত দেখে নেওয়ার কথা। তার কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। সঞ্জয় রায়ের অপরাধমূলক অতীত রেকর্ড থাকলেও তাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। সে যে বাইক ব্যবহার করতো, তা কলকাতা পুলিশ কমিশনারের নামে রেজিস্টার করা। সে পুলিশ ব্যারাকে থাকতো। আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তার সখ্য ছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। বস্তুত, সিবিআই সূত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, সঞ্জয়ের সঙ্গে পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠতার কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

আনিস খান হত্যা মামলায় সিভিক ভল্যান্টিয়ার

২০২৩ সালে হাওড়ায় বাড়ির ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে হত্যা করা হয় আনিস খানকে। যা নিয়ে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। সেই ঘটনাতেও আঙুল উঠেছিল সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের দিকে। অভিযোগ, আনিসের বাড়িতে ঢুকে পুলিশ এবং সিভিক ভল্যান্টিয়াররা ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের এক মামলায় বিচারপতি বলেছিলেন, আনিস খানের বাড়িতে কেন সিভিক ভল্যান্টিয়ার গেছিল? ওই মামলার প্রেক্ষিতে বিচারপতি নির্দেশ দেন, আইন-শৃঙ্খলাজনিত কোনো মামলায় সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের যুক্ত করা যাবে না। শুধু তা-ই নয়, বিচারপতির মন্তব্য ছিল, যতদিন রাজ্যে কনস্টেবল এবং এএসআই নিয়োগ হবে না, ততদিন এদের দিয়েই কাজ চালাতে হবে। দেশের আর কোথাও এমনটা হয় না।

সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়ে একাধিক মামলা

২০১৬ সালে সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়োগ নিয়ে মামলা হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসে সেই মামলায় কড়া সমালোচনা করেছিলেন বিচারপতি। বলেছিলেন, 'বড় কেলেঙ্কারি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। রাজ্যে প্রশাসনিক অরাজকতা চলছে। কাগজপত্র দেখে মনে হচ্ছে নিয়োগপ্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ।' ২০১২ সালে সারেঙ্গা থানায় ১৩৫১ জন সিভিক ভল্যান্টিয়ারের নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছিল। বিচারপতির প্রশ্ন, 'যারা ইন্টারভিউ নেন, তারা কি সুপারম্যান? সবার জন্য এক মিনিট সময় দেওয়া হলে ২২ ঘণ্টা ৩১ মিনিট সময় লাগে। ইন্টারভিউ কি রাত তিনটে থেকে শুরু হয়েছিল? যারা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন, তারা স্নান-খাওয়া করেনি, শৌচাগারে যাননি?'

ওই মামলায় অন্যতম আইনজীবী ছিলেন ফিরদৌস শামিম। তিনি জানিয়েছেন, ''হাইকোর্টের ওই মামলাতেই প্রায় স্পষ্ট হয়ে গেছিল, সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়োগে কী পরিমাণ দুর্নীতি চলছে রাজ্যে। বস্তুত, মামলাকারীরা যাতে আমাদের কাছে পৌঁছাতে না পারেন, তার ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য।''

‘যারা বলছেন আন্দোলন থেমে গেল, তারা ভুল ভাবছেন’

বস্তুত, হাইকোর্টের নির্দেশে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছিল, সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের কোনোভাবেই আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক মামলায় যুক্ত করা যাবে না। তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রিমিনাল রেকর্ড দেখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে?

রাজ্য এবং কলকাতা পুলিশে সিভিক ভল্যান্টিয়ারের সংখ্যা

কলকাতা পুলিশে স্থায়ী পুলিশ কর্মচারীর সংখ্যা ৩৭ হাজার ৪০০। সিভিক ভল্যান্টিয়ারের সংখ্যা সাত হাজার ২০০। অন্যদিকে রাজ্য পুলিশে মোট পুলিশ কর্মচারীর সংখ্যা ৭৯ হাজার ৩২। সেখানে সিভিক ভল্যান্টিয়ারের সংখ্যা এক লাখ ২৪ হাজার। অর্থাৎ,রাজ্য পুলিশ বিভাগে পুলিশ কর্মচারীর চেয়ে সিভিক ভল্যান্টিয়ারের সংখ্যা বেশি। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময় বলেছিলেন, এই সিভিক ভল্যান্টিয়ারদেরই একসময় হোম গার্ডের কাজে নিযুক্ত করা হবে।

কীভাবে নিয়োগ হয়?

কলকাতা পুলিশের এক অফিসার নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র বিভাগের একটি বিজ্ঞপ্তি মেনে সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের নিয়োগ করা হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় একটি বিষয়ে। আবেদনকারী যেন স্থানীয় কমিশনারেট এলাকার বাসিন্দা হন। নিয়োগের জন্য ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাশ হতে হবে। এনসিসি, স্কাউট ইত্যাদি কোর্স করা থাকলে ভালো। আবেদনকারীর বয়স হতে হবে অন্তত ২০। গাড়ি চালানোর, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ থাকতে হবে আবেদনকারীর। যে ফর্ম আবেদনকারীকে ভর্তি করতে হয়, সেখানে একটি কলমে জানাতে হয়, তার বিরুদ্ধে থানায় কখনো কোনো অপরাধমূলক মামলা হয়েছিল কি না!

নিয়োগকর্তা কে?

তিন পুলিশকর্তার একটি নিয়োগ কমিটি গোটা প্রক্রিয়ার মাথায় থাকেন। নিয়োগ কমিটির মাথায় থাকেন ডেপুটি কমিশনার পদমর্যাদার একজন অফিসার। যিনি ওই ডিভিশনের দায়িত্বে। বাকি দুই অফিসারের একজন অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার এবং অন্যজন ইনস্পেক্টর।

নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সমস্যা তৈরি হলে হস্তক্ষেপ করবেন পুলিশ কমিশনার, অ্যাডিশনাল বা অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এবং জয়েন্ট কমিশনারকে নিয়ে তৈরি অ্যাপিলেট বোর্ড।

নিয়োগের পর হোমগার্ডদের যেখানে ট্রেনিং হয়, সেখানে এই সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের দু'সপ্তাহের একটি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

‘এই আন্দোলনের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়াতে চাই’

নিয়োগ-রাজনীতি

আইনজীবী অরিন্দম দাসের বক্তব্য, ''নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে দুর্নীতি হচ্ছে না, তা কে দেখছে? ফর্মে ক্রিমিনাল রেকর্ডের কলম দেওয়া আছে, কিন্তু বাস্তবে তা যাচাই করা হচ্ছে কি? যে পরিমাণ সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়োগ করা হচ্ছে, তাতে এই ভেরিফিকেশন করা প্রায় অসম্ভব।'' বস্তুত, ২০১৬ সালে বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ, যেহেতু সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের নিয়োগ এলাকাভিত্তিক, অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নয়, ফলে শাসক দলের নেতা, আধানেতাদের প্রবল চাপ থাকে। তাদের পছন্দের লোকেদের নিয়োগের জন্য চাপসৃষ্টি করা হয়। আইনজীবী তথা বিজেপি নেতা কৌস্তভ বাগচীর বক্তব্য, তিনি প্রমাণ করে দিতে পারেন, কীভাবে সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ কাজ করে। এবং নিয়োগে তার প্রতিফলন ঘটে। বস্তুত, সুপ্রিম কোর্টেও এই প্রশ্ন উঠেছে। সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কতটা?

সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের ট্রেনিং নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। পুলিশের মতো একটি রেজিমেন্টেড ফোর্সে দু'সপ্তাহের ট্রেনিং যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সাবেক পুলিশপ্রধান সন্ধি মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি তার প্রশ্ন, নির্বাচন থেকে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক ঘটনা-- সমস্ত ক্ষেত্রেই সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের উপস্থিতি দেখা যায়। পুলিশের কাজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। ফলে তার সঙ্গে যে ফোর্স সিভিক ভল্যান্টিয়ার নামে কাজ করে, তাকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাইরে রাখা হবে কী করে?

এখন দেখার আরজি কর মামলার পরবর্তী শুনানিতে রাজ্য কী জবাব দেয়।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো