শিক্ষা নিয়ে ফলাও ব্যবসা
২ জুলাই ২০১৮পরীক্ষায় যেমন এক শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা না করে টুকে পাস করে, তেমনি কিছু পড়ুয়া সোজা রাস্তায় পছন্দের কলেজে ভর্তি না হতে পেরে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে যায়৷ এটা বরাবরই হয়ে আসছে৷ সেই খিড়কি তাদের জন্যে কে বা কারা খুলে দেয় এবং সেটা কীসের বিনিময়ে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়৷ কিন্তু সেই পিছনের দরজা আর আড়ালে আবডালে চলা বেআইনি কারবার এখন কলেজের সদর দরজায় এসে ঘাঁটি গেড়েছে৷ কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতামান পেরোলে, বাছাই তালিকায় নাম থাকলেই শুধু চলছে না, ফটকের সামনে ব্যবসা ফেঁদে বসা দাদা-দিদিদের সঙ্গে রফা করে, তাদের যথেষ্ট পরিমাণ উৎকোচ দিয়ে তবেই কলেজের ভেতরে যাওয়া যাচ্ছে৷
কলকাতা এবং মফস্বলের প্রায় সব কলেজে এখন এটাই দস্তুর৷ অর্থাৎ, কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম তোলা, ফের লাইনে দাঁড়িয়ে সেই ফর্ম জমা দেওয়া এবং সেই সংক্রান্ত বহু অনিয়মের অবসান ঘটাতে যে অনলাইন ভর্তি পদ্ধতি চালু করা হলো, তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি৷ কারণ, কাউন্সেলিংয়ের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজে আসতেই হচ্ছে এবং তখনই তারা পড়ছে দাদা-দিদিদের খপ্পরে৷ প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট ‘রেট' বেঁধে দিয়েছে এই দালালরা৷ তাদের সঙ্গে রফা করে, তবেই প্রবেশাধিকার মিলছে৷
কারা এরা, যারা কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া কার্যত নিজের হাতে তুলে নিয়েছে? বেশিরভাগই কলেজের একটু সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রী, যাদের সঙ্গে আছে পাস করে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা এবং পিছনে আছে স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নের নেতা-নেত্রীরা৷ এই ছাত্র সংসদগুলি এখন প্রায় সবই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের অধীনে৷ ফলে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, শাসকদলের নেতা-নেত্রীরাও এই বেনিয়মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত জোগাচ্ছেন৷
যদিও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় চলতি অরাজকতার প্রেক্ষিতে বার বার বলছেন, যে বা যারা টাকা নিয়ে ভর্তি করছে, তাদের সম্পর্কে সরাসরি অভিযোগ জানাতে৷ দোষীরা যদি কলেজের এখনকার ছাত্র-ছাত্রী হয়, তা হলে কলেজ কর্তৃপক্ষই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে৷ আর বাইরের কেউ হলে শাস্তি দেবে প্রশাসন৷ বস্তুত রাজ্যের অনেক কলেজেই এখন মোতায়েন হয়েছে পুলিশ৷ প্রায় প্রতিদিনই একজন-দুজন করে ছাত্র পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছে ভর্তির বিনিময়ে টাকা নিতে গিয়ে ধরা পড়ে৷ কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না৷ ভর্তি ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই পরিস্থিতি দেখে অত্যন্ত বিরক্ত৷ যেসব কলেজে তাঁর দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে ভর্তির অভিযোগ উঠেছে, সেসব কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি৷
কিন্তু কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন বন্ধ রাখা এবং বিরোধী শক্তি বলে কিছু না থাকাই এই সমস্যার মূল কারণ বলে মনে করছেন একসময়ের ছাত্রনেতা রঞ্জিত সাহা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, বিভিন্ন দল থেকে যারা নেহাতই ব্যক্তিগত স্বার্থে তৃণমূল কংগ্রেসে এসে জুটেছে, এই ভর্তি চক্রের পিছনে মূলত তারাই আছে৷ নিজে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক হয়েও রঞ্জিত বলছেন, সময় থাকতে এটা বন্ধ করা হয়নি৷ একটা ক্ষত তৈরি হয়েছিল, তার চিকিৎসা করা হয়নি সময়মতো৷ এখন সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে৷ অন্যদিকে ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের বাবা-মায়েদেরও দোষ দিচ্ছেন রঞ্জিত৷ তাঁ প্রশ্ন– তাঁরা কেন টাকা দিয়ে ভর্তির ওই ফাঁদে পা দিচ্ছেন? কেন তাঁরা ওই দালালদের গিয়ে বলছেন, যদি কিছু লাগে, তাঁরা দিতে তৈরি! কথা প্রসঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন রঞ্জিত সাহা৷ তাঁর উদ্বেগ, যারা আজ এভাবে অসাধুপথে কলেজে ভর্তি হচ্ছে, তারা যখন ভবিষ্যতে পেশাদার জীবনে পা রাখবে, তখন কী ভয়ঙ্কর অসততাকে পুঁজি করে নিয়ে যাবে!