পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখের উদযাপন
১৫ এপ্রিল ২০২৩১৪৩০ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাচ্ছে এই বাংলা। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে হোর্ডিং সারা বাংলাজুড়ে। সেজে উঠেছে দোকান-বাজার। রেস্তোরাঁয় বিশেষ খানাপিনার আয়োজন। নববর্ষের উৎসবে পান্তা ও শুঁটকি ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ। শাড়ির সঙ্গে পাঞ্জাবি আজ পশ্চিমি পোশাককে টেক্কা দিচ্ছে।
বইপাড়ায় বছরপয়লা
বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি বইপাড়ার বড়দিন। কলেজ স্ট্রিট চত্বর সেজে উঠেছে ফুল-মালায়। প্রকাশকদের ঘরে এ দিন ঢালাও মিষ্টি, পানীয়ের আয়োজন। বেলা গড়াতেই লেখক-সাহিত্যিকরা আসতে শুরু করেন। তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আশায় উপস্থিত পাঠককুল। সেখানেই আলাপচারিতা, বইয়ের আড্ডা। কোনো কোনো প্রকাশনা সংস্থা নতুন বই প্রকাশ করে এ দিন। কোনো প্রকাশক ঢালাও ছাড়ের উপহার দেন পাঠককে।
বই পড়ার অভ্যাস কমেছে, অডিও-ভিস্যুয়াল কেড়ে নিচ্ছে সেই পরিসর। এমন কথা অহরহ শোনা যায়। তবে বছরপয়লায় কলেজ স্ট্রিটে লেখক-পাঠকের উপস্থিতিতে যে উষ্ণতা লক্ষ্য করা যায়, তা অন্য কথা বলে। পাঠকদের বেষ্টনীতে বসে সাহিত্যিক অমর মিত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আগে মূলত পয়লা বৈশাখে নতুন বই বেরোত। এখন সিজন পাল্টেছে, বইমেলায় বেরোয়। কিন্তু তাতে এ দিন বইপাড়ায় আড্ডা দেয়ার আনন্দ কমেনি।”
লেখক-প্রকাশক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এই আড্ডাকেই গুরুত্ব দিলেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বই প্রকাশের ক্ষেত্রে পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব আগের মতো নেই। তবে মেলায় ভিড়ের জন্য লেখক-পাঠকের মুখোমুখি হওয়ার অবকাশ থাকে না। বছরের শুরুর দিনে কলেজ স্ট্রিটে সেই সুযোগটা হয়। সেখানেই পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব।''।
প্রকাশকদের ঘরে এ দিন সাজ সাজ রব। কলকাতার অগ্রণী প্রকাশক দেজ পাবলিশিং-এর নববর্ষ উদযাপন এ বার ৫২ বছরে। প্রকাশনার অন্যতম কর্ণধার শুভঙ্কর দে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এ বারের আড্ডার আকর্ষণ লেখকদের গান, কবিতাপাঠ। সাহিত্যিক ভগীরথ মিশ্র বলেছিলেন ম্যাজিক দেখাবেন। কিন্তু তার অভ্যাস না থাকায় যাত্রার সংলাপ বলতে চাইলেন। উনি একসময় যাত্রায় অভিনয় করেছেন। লেখকরা যে যা পারেন, সেটাই আড্ডায় তুলে ধরছেন।”
হালখাতার পার্বণ
নতুন বছরকে আবাহনের পাশাপাশি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন খাতা বা হালখাতার পার্বণে মেতে ওঠে বাঙালি। সিদ্ধিদাতা গণেশ ও লক্ষ্মীপুজো করেন ব্যবসায়ীরা। এ বছরের নতুন খাতা খোলা হয়। দোকানে ভিড় জমান ক্রেতারা। মিষ্টিমুখ করানো হয় তাদের। গত কয়েকবছর দীপাবলির আগে ধনতেরাস উৎসবের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে বাংলায়। তবু চিরাচরিত রীতি মেনে আজো বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে কলকাতার বৌবাজার এলাকায় হালখাতা পালিত হয়। ঝলমলে বিপণি সাজানো হয়। স্বর্ণ ব্যবসায়ী গণেশ শাসমল বলেন, "ধনতেরাসে অবাঙালিদের আগ্রহ বেশি। বাঙালিরাও তা নিয়ে মেতেছে। তবে পয়লা বৈশাখেও দোকানে ভিড় হয়। কেনাকাটা বেশি হয় ধনতেরাসে।''
নিরানন্দের যাত্রাপাড়া
যাত্রাশিল্প তার গৌরবের দিন পার করে এসেছে। বছরপয়লায় যাত্রাপাড়াও গমগম করত। একসময় গ্রামবাংলায় যাত্রার মৌসম ছিল চৈত্র-বৈশাখ। এ সময় নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মেতে থাকে গ্রামীণ এলাকা। তাই গাজন, চড়ক, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা যাত্রার আয়োজন করতেন। তাই এই সময়টা যাত্রাশিল্পের কলাকুশলীরা খুব ব্যস্ত থাকতেন।
পয়লা বৈশাখ কলকাতার যাত্রাপাড়া চিৎপুরে হালখাতা হত। উদ্যোক্তারা বায়না দিতেন, যাত্রাদলের কর্তারা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। আজ সেই পাড়া শুনশান। এই আক্ষেপ ঝরে পড়ল ভৈরব অপেরার কর্ণধার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়। পালাকার-প্রযোজক-নির্দেশক মেঘদূত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরস্বতী পুজো, পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া মানে যাত্রাপাড়ায় উৎসব। অফিসঘর সাজানো হত। কত মানুষ আসতেন। আজ সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। টিকে আছে রথের দিনটি।”
টলিপাড়া থেকে ময়দান
টালিগঞ্জে পয়লা বৈশাখ নতুন ছবির শুভ মহরত হতো একটা সময়ে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন আমন্ত্রিত থাকতেন। ক্যামেরা, ক্ল্যাপস্টিক পুজো করা হতো। এর সঙ্গে হইহুল্লোড়, খাওয়াদাওয়া। চলচ্চিত্র পরিচালক রাজা সেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা খুবই দুর্ভাগ্যের। আমরা টলিপাড়ায় আর নববর্ষ পালন করি না। এটা দেখেই বোঝা যায়, আমাদের সংস্কৃতি অবলুপ্তির পথে।”
কর্পোরেটে মোড়া হলেও বাঙালির নববর্ষের সংস্কৃতিকে কিছুটা ধরে রেখেছে ময়দান। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে কৃতী বাঙালি ফুটবলার এখন হাতে গোনা। তবু বছরের প্রথম দিন বড় ক্লাবের মাঠে বারপুজো হয়। ভিড় জমান কর্তা থেকে সমর্থকরা। এই দৃশ্যও কি যাত্রা বা টলিপাড়ার মতো ভাবীকালে হারিয়ে যাবে, পয়লা বৈশাখ এই প্রশ্ন রেখে গেল!