ফাঁদে মমতার সরকার
১৩ জানুয়ারি ২০১৭মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর আন্দোলনের সাফল্য আজ তাঁর সরকারেরই গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে৷ অন্তত দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ভাঙড়ে পরিস্থিতি সেরকমই৷ হাই টেনশন বিদ্যুতের লাইন নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০১৪ সালে এখানে ৮০ বিঘার মতো উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করেছিল সরকার৷ স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, তাঁদের জানানো হয়নি, তাঁদের মতামতের তোয়াক্কা করা হয়নি, উল্টে এলাকার তৃণমূল গুন্ডাদের দিয়ে চাপ তৈরি করে, কার্যত জোর করে কিনে নেওয়া হয়েছে তাঁদের জমি৷ সেটাও কেনা হয়েছে ধমক, হুমকি দিয়ে, চলতি বাজারদরের থেকে অনেক কম দামে৷ স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন এই ঘটনায় নীরব দর্শক হয়েই থেকেছে৷ বরং তলায় তলায় হুমকিবাজ গুন্ডাদের মদত দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে৷ ফলে শুরু থেকেই এই অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে একটা চাপা ক্ষোভ ছিল৷ সেই ক্ষোভ জমতে জমতে এবার বিস্ফোরণ ঘটেছে৷ ভাঙড় এবং লাগোয়া দেগঙ্গা আর রাজারহাট অঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার গ্রামবাসী এখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন৷ প্রকাশ্যে অভিযোগ জানাচ্ছেন রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের দাদাগিরির বিরুদ্ধে৷ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রশাসনের উদাসীনতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন৷
গত ১১ জানুয়ারি এরকমই এক প্রতিবাদী কৃষক সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে দো-ফসলা, তে-ফসলা চাষের জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না৷ জমির মালিকের কথাই শুনতে হবে৷ সিঙ্গুরে যদি সেই রায় মান্যতা পায়, ভাঙড়ে তার অন্যথা হবে কেন! কৃষকদের দুশ্চিন্তা, ৪০০ কিলোভোল্ট বিদ্যুৎবাহী তারের জন্য সার দিয়ে ইস্পাতের কাঠামো বসাতে গিয়ে শুধু উর্বর কৃষিজমিই বরবাদ হবে না, তার চারপাশের যে জলাভূমি, তার প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হবে৷ ঘন জনবসতি এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা কৃষির সঙ্গেই জুড়ে আছে৷ তাঁরা কাজ হারাবেন, নতুন জীবিকার সন্ধানে বাস্তুচ্যুত হবেন বাধ্য হয়ে৷ স্থানীয় কৃষকদের আরও বড় ক্ষোভ এবং আপত্তি, ‘মা-মাটি-মানুষ'-এর সরকার কেন মানুষের সঙ্গেই কথা বলছে না! কেন তাঁদের মতামত, চাওয়া, না চাওয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে না! কেন গুন্ডা দিয়ে, পুলিস দিয়ে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করছে! কেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বন্দুকের মুখে জমি জবরদখল করছে!
বস্তুত গত কয়েকদিন ধরে ভাঙড়ে যা ঘটছে, তা যেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রাকমূহূর্তের পুনর্নির্মাণ৷ যেন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি৷ জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করতেই ভাঙড়ে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে, যে আইনে পাঁচজনের বেশি জনসমাবেশ নিষিদ্ধ৷ আইন ভাঙলে, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয়েছে দাঙ্গা মোকাবিলা বাহিনী ‘র্যাফ'৷ তাদের হাতে বন্দুক ছাড়াও রয়েছে কাঁদানে গ্যাস, সঙ্গে জল-কামান৷ এবং ভাঙড়ের আন্দোলনের খবর এবং তার বিরুদ্ধে এই প্রশাসনিক পদক্ষেপের কথা যাতে বাইরে ছড়াতে না পারে, তার জন্য গোটা এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু এই সরকারি কঠোরতার তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে৷ এলাকার মানুষ ১৪৪ ধারার পরোয়া না করে রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন৷ বাইরেও খবর ঠিকই পৌঁছেছে৷ ঝাঁক বেঁধে এসেছে সংবাদমাধ্যম৷ তাদের সঙ্গী হয়ে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, যাঁরা এর আগেও এই ধরনের গণ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, বিশেষত নন্দীগ্রামে৷ এবং এঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন একাধিক কট্টর বামপন্থি দল ও মানবাধিকার সংগঠন৷ তৈরি হয়েছে কৃষিজমি, জীবন ও জীবিকা রক্ষা কমিটি৷ গত কয়েক মাস ধরে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল, তা বদলে গেছে জঙ্গি আন্দোলনে৷
আবারও উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে এই গণবিক্ষোভের মূল শক্তি সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায়, যার সার কথা হলো, জোর করে কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া যাবে না৷ পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এখন কী করে নিজেদের তৈরি এই সামাজিক-রাজনৈতিক মতবাদের বিরোধিতা করে, কোন যুক্তিতে, সেটাই এবার দেখার৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷