পর্যটন: সম্ভাবনার বিকাশে প্রয়োজন শান্তি
৩১ অক্টোবর ২০১৬ডয়চে ভেলেকে কথাগুলো বলছিলেন বেঙ্গল ট্যুরস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন৷ তিনি বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটরসদের সংগঠন টোয়াবেরও সাবেক সভাপতি৷ মাসুদ হোসেন আরো বলেন, ‘‘এর আগে বাংলাদেশে দুই বিদেশি হত্যার ঘটনায় বিদেশি পর্যটকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও পরিস্থিতি তত খারাপ ছিল না৷ কিন্তু হোলি আর্টিজানের পর পরিস্থিতি চরম খারাপ হয়৷''
তবে মাসুদ হোসেন মনে করেন, ‘‘এটা বড় কোনো সমস্যা নয়৷ এ ধরণের সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হামলা পৃথিবীর অনেক দেশেই হয়৷ তারপরও সেখানে পর্যটন ব্যবসায় তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না৷ তাই দরকার হলো সরকারের উদ্যোগ৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং দেশের পর্যটনের ব্র্যান্ডিংয়ে আমরা কতটা আন্তরিক তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু৷''
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. অপরূপ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, বিদেশি নাগরিক হত্যা এবং হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় আমাদের পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷ তবে সেটা সাময়িক৷ এবং এরইমধ্যে আমরা সেটা কাটিয়ে উঠেছি৷ ঐ সব ঘটনার পর বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণের ব্যাপারে নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করে৷ তবে অনেক দেশই সেই সকতর্কতা তুলে নিয়েছে৷ সরকার সফলভাবে জঙ্গি দমন করায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷''
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অগ্রগতি সার্বিক বিবেচনায় ইতিবাচক৷ যদিও সেই অগ্রগতি হচ্ছে অত্যন্ত ধীর গতিতে৷ জিডিপিতে এই খাতের অবদান দুই শতাংশেরও কম৷ কিন্তু সাধারণভাবে ১০ শতাংশ অবদান রয়েছে বিভিন্ন দেশে৷ কোনো কোনো দেশে জিডিপি'র ৪০ থেকে ৫০ ভাগ আসে পর্যটন খাত খেকে৷
বাংলাদেশ ব্যংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সরকারের বৈদেশিক আয় হয়েছে ৪ হাজার ১৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা৷ এর মধ্যে ২০১০ সালে বৈদেশিক আয় ছিল ৫৫৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যা ২০১৪ সালে বেড়ে হয় ১ হাজার ২২৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১১ সালে ৬২০ কোটি ১৬ লাখ, ২০১২ সালে ৮২৫ কোটি ৪০ লাখ এবং ২০১৩ সালে ৯৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে বিদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে৷ ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নেয়া হয়েছে৷ আর চলতি ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে৷
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিলের মতে, ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে ১৩ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ৷ ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে৷ সেই হিসাবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানে মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দেব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পর্যটন খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে৷ তবে সম্ভাবনার তুলনায় প্রবৃদ্ধি কম৷ আমরা গবেষণায় দেখেছি মোট জিডিপ'র ১০ শতাংশ এই খাত থেকে আয় করা সম্ভব৷ কিন্তু সামনের বছর তা হয়ত শতকরা ২ ভাগ ছাড়াবে৷ সরকার কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে৷ তবে তা আরো বেশি হওয়া প্রয়োজন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বিদেশি হত্যা এবং হোলি আর্টিজানের কারণে বাংলাদেশে পর্যটন ব্যবসায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও তা এখন কাটিয়ে ওঠার পথে৷''
বাংলাদেশে পর্যটনের প্রধান আকর্ষণ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ হোসেন বলেন, ‘‘এক কথায় আমি বলবো, বাংলাদেশের মানুষ৷ এখানকার মানুষের সরলতা, সহজ জীবন যাপন, সংস্কৃতি বিদেশিদের আকর্ষণ করে৷ এর বাইরে সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন সাধারণভাবেই পর্যটনের আকর্ষণ৷''
বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পর্যটনকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান জানান, ‘‘এ জন্য আমরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছি৷ তরুণদের, যুবকদের আকৃষ্ট করতে আছে নানা প্যাকেজ, নানা আয়োজন৷ আর তাই দল বেধে দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়া জনপ্রিয় হচ্ছে৷''
সায়মা সিদ্দিকা সেরকমই এক তরুণী৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা দল বেধে সময় করে দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরি৷ ট্যুর অপারেটরদের সহায়তায় আমরা প্যাকেজ টুরে যাই৷ আমার কাছে ভালো লাগে বান্দরবান৷ আবার কেউ পছন্দ করেন সুন্দরন, টাঙ্গুয়া হাওর বা রাতার গুল৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন প্রধান সমস্যা যোগাযোগ ও পরিবহন৷ নিরাপত্তা আগের চেয়ে অনেক ভালো৷ স্থানীয় লোকজনও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ৷ তবে কারো কারো মধ্যে পর্যটন মানসিকতার অভাব আছে৷''
মহিউদ্দিন হেলাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই পর্যটনঅন্ত:প্রাণ৷ এখন ‘পর্যটন বিচিত্রা' নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন৷ আছে নিজের প্রতিষ্ঠান ‘রিভার অ্যান্ড গ্রিণ ট্যুরস'৷ আর প্রতি বছর তার প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় আয়োজন করা হয় এশিয়ান টুরিজম ফেয়ার৷
হেলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এই ফেয়ারের উদ্দেশ্য কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেশের পর্যটনকে পরিচিত করতে চাই বিশ্বের কাছে৷ মেলায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশের টুর অপরেটররা অংশ নেন৷ আমাদের দেশের টুর অপারেটররাও থাকেন৷ আর যাঁরা দর্শক তাঁরা জানতে পারেন কোথায় যাবেন, কিভাবে যাবেন৷''
মহিউদ্দিন হেলাল আরো বলেন, ‘‘দেশের মানুষকে দেশ দেখানো – এই স্লোগান নিয়েও আমরা কাজ শুরু করেছি৷ আমরা চাই ডমেস্টিক টুরিজম বাড়ুক৷''
পর্যটন কর্পোরেশন জানায়, বাংলাদেশে ৬৮টি পর্যটন স্পট এবং আবাসনের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ৪০৪টি তিন তারকা বা তার চেয়ে আধুনিক হোটেল, মোটেল আছে৷ তবে পর্যটক মানেই ধনী এই ধারণা ঠিক নয়৷ তাই স্থানীয়ভাবে আরো কম দামের আবাস হচ্ছে৷ বিশেষ করে টুরিস্ট পুলিশ গঠনের পর নিরাপত্তা আগের চেয়ে ভালো হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কম দামের কিন্তু ভালো হোটেল, কটেজ হচ্ছে৷ আর এখন কোনো কোনো এলকার অধিবাসীরাই তাদের বাড়িকে পর্যটকদের থাকার উপযোগী করে পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন৷
বাংলাদেশে পর্যটনের জন্য আকর্ষণের বিষয়গুলোকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায়:
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ: লালবাগ কেল্লা, মুঘল ঈদগাহ, আহসান মঞ্জিল, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোনারগাঁও, উয়ারী বটেশ্বর, ময়নামতি, পাহাড়পুর, কান্তজির মন্দির, মহাস্থানগড়৷
সমূদ্র সৈকত: কক্সবাজার, পতেঙ্গা, পারকী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা, কটকা৷
পাহাড় ও দ্বীপ: রাঙামাটি হ্রদ জেলা, কাপ্তাই হ্রদ শহর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, মহেশখালী দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ৷
ঐতিহাসিক স্থানসমূহ: জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, জাতির পিতার সমাধিসৌধ, জাতীয় কবির সমাধিসৌধ, কার্জন হল, বলধা গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, বাহাদুর শাহ পার্ক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধি, শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সাগরদাড়ি, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, ত্রিশাল, গান্ধী আশ্রম৷
বন ও জলাবন: সুন্দরবন, টাঙ্গুয়া হাওড়, বিছানাকান্দি, রাতারগুল জলাবন৷
অন্যান্য আকর্ষণীয় স্থানসমূহ: জাতীয় সংসদ ভবন, বঙ্গভবন, শাঁখারি বাজার, সদরঘাট, রমনা পার্ক, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, জাতীয় চিড়িয়াখানা, জাতীয় উদ্যান, বাটালী পাহাড়, যমুনা ব্রিজ, মাধককুণ্ড, জাফলং৷
পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. অপরূপ চৌধুরী বলেন, ‘‘এখন ইকো টুরিজমকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি৷ আমরা চাই প্রকৃতিকে ঠিক রেখে পর্যটককে আকৃষ্ট করতে আর নানা ইভেন্টভিত্তিক পর্যটনের ব্যবস্থা করতে৷''
বাংলাদেশে এখন তিন শতাধিক টুর অপারেটর কাজ করছে৷ তারা বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে যেমন কাজ করে, কাজ করে অভ্যন্তরীণ পর্যটন নিয়েও৷ তবে শুধু বিদেশিদের নিয়ে কাজ করে এমন অপারেটর ৩০টির বেশি নয়৷
মাসুদ হোসেন দাবি করেন, ‘‘পর্যটন কর্পোরেশন যা-ই বলুক না কেন, বাংলাদেশে এখন পর্যটন ব্যবসায় মন্দা চলছে৷ বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে ব্যবসা পাঁচ ভাগের একভাগে নেমে এসছে৷ আমাদের এখন প্রয়োজন ব্র্যান্ডিং৷ আর তার জন্য প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ৷ পর্যটকরা যদি প্রথমে বিমান বন্দরেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুকি হন, তাহলে কিভাবে হবে?''
প্রতি বছর একশ' কোটিরও বেশি পর্যটক সারা বিশ্বে ভ্রমণ করলেও বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা এখনও বছরে মাত্র ৫ লাখের মতো৷
পর্যটন খাত সরাসরি যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ২.২৩ ট্রিলিয়ন ডলার অবদান রাখছে, সেখানে বাংলাদেশ পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে৷
টোয়াবের হিসাব মতে, ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে৷ আর এবার বিদেশি হত্যা এবং হোলি আর্টিজান হামলার পাকে পড়েছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প৷ বিশ্লেষনে দেখা যায়, ২০১২-১৩ সাল বাংলাদেশের পর্যটনের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো সময়৷ তখন কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সংকট ছিল না৷ পর্যটনে সুদিন ফেরাতে হলে তাই সবার আগে দরকার ‘শান্তি'৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷