1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রকৃতি যখন শত্রু

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা৮ জুলাই ২০১৩

কারণ হিসেবে নানা তথ্য এবং তত্ত্ব উঠে আসছে, কিন্তু ঘটনা হলো সাধারণ পর্যটক থেকে শুরু করে দক্ষ পর্বতারোহী, সবাই প্রকৃতির রুদ্ররূপের পরিচয় পেলেন উত্তরাখণ্ড রাজ্যে৷

https://p.dw.com/p/1937U
ছবি: Manan Vatsyayana/AFP/Getty Images

এ বছরেরই এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি কলকাতার জার্মান কনসুলেট থেকে আমরা খবর দিয়েছিলাম, শহরের পর্বতারোহী ও অভিযাত্রীদের এক পরিচিত সংগঠন সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন এবার যে গঙ্গোত্রী-থ্রি শৃঙ্গ অভিযান করছে, তার আর্থিক সহায়তা করবে ওয়াকার নামে এক ইন্দো-জার্মান রাসায়নিক সংস্থা৷ কলকাতায় জার্মান কনসাল জেনারেল রাইনার শ্মিডশেন নিজেই পর্বতারোহী সংস্থাটির জন্য আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করে দিতে উদ্যোগী হন এবং বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও এক ধরনের অভিভাবকসুলভ তদারকির দায়িত্ব নেন৷ কিছুদিন আগেই জার্মান কনসুলেট থেকে আরও একটি ই-মেল আসে সাংবাদিকদের কাছে যে চলতি জুলাই মাসের শেষ দিকে এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে নিজেদের সাফল্য অভিজ্ঞতার কথা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের পর্বতারোহীরা৷ তখনও কারও জানা ছিল না, কী ভয়ংকর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় উত্তরাখণ্ডের উপর নেমে আসতে চলেছে৷

Indien General Schmiedchen South Kolkata Trekkers Association
কলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল রাইনার শ্মিডশেন (মাঝে)ছবি: DW/S. Bandopadhya

জার্মান কনসুলেটে এ মাসের শেষে নির্ধারিত অনুষ্ঠানটি এখনও বাতিল হয়নি৷ বরং শোনা যাচ্ছে, গঙ্গোত্রী-থ্রি অভিযানে যাওয়া পর্বতারোহীরা অবশ্যই আসবেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে৷ তবে সেটা শৃঙ্গজয়ের সাফল্য নয়, প্রচণ্ড প্রতিকূল পার্বত্য আবহাওয়া এবং প্রকৃতির রুদ্রমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কীভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে পাহাড় থেকে সমতলে ফিরে আসতে পেরেছেন ওঁরা, তারই রোমহর্ষক কাহিনি শোনাবেন ওই অভিযাত্রীরা৷ তবে ওঁরা শহরে ফিরে আসার পর টুকরো-টাকরা যে অভিজ্ঞতার কথা জানা গিয়েছে, তাতে বোঝাই যায় যে, স্রেফ কয়েকজন শেরপার উপস্থিত বুদ্ধি এবং অদম্য সাহস, আর তার সঙ্গে ওদের নিজেদেরও কষ্টসহিষ্ণুতা এবং নিশ্চিত মৃত্যু থেকে অকল্পনীয়ভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে ওঁদের৷ প্রবল তুষারঝড়, হাঁটু অবধি জমে থাকা বরফের মধ্যে আটকে পড়া, অক্সিজেনের অভাবজনিত অসুস্থতা, অথবা ধস নামা পাহাড় থেকে ছিটকে আসা বিশাল পাথরের চাঁই, যে কোনও কিছুই ওঁদের নিশ্চিত মৃত্যুর কারণ হতে পারত৷

আর যাঁরা বাঁচতে পারলেন না? সেনাবাহিনী এবং আধা সেনা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের পার্বত্য এলাকা জুড়ে যে ব্যাপক উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছিল, সোমবার, ৮ জুলাই তার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে৷ এবং এতদিনেও যাঁদের খোঁজ পাওয়া গেল না, সরকারিভাবে তাঁদের মৃত ঘোষণা করা হবে৷ বেসরকারি ও অসমর্থিত সূত্রের খবর অনুযায়ী সেই নিখোঁজ ও সম্ভাব্য মৃতের সংখ্যাটা প্রায় ১০ হাজার, অর্থাৎ আগে যত সংখ্যক প্রাণহানি ভাবা হয়েছিল, তার ঠিক দ্বিগুণ৷

Überschwemmungen Indien
সম্প্রতি উত্তরাখন্ডে বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছবি: Reuters/Stringer

উত্তরাখণ্ড প্রশাসন জানিয়েছে, এই ব্যাপক সংখ্যক মৃতদেহের পচন থেকে যাতে নদীতে, পাহাড়ে দূষণ না ছড়ায়, তার জন্য গোটা রাজ্যে ওষধি গ্যাস ছড়ানো হবে৷ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই হতাশা ছড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বহু পরিবারে, যাদের সদস্যরা তীর্থযাত্রায়, পর্বতারোহণে, অথবা নিছক বেড়াতেই এবার উত্তরাখণ্ডে গিয়েছিলেন৷ ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির অন্যতম প্রিয় গন্তব্য ছিল উত্তরাখণ্ড৷ এখন এক এক করে খবর আসছে, কারা এখনও ঘরে পেরেননি, কারা এখনও নিখোঁজ৷

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, পার্বত্য এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এমন মারাত্মক ধস, মেঘফাটা বর্ষণ বা ক্লাউড-বার্স্ট এবং কাদা-জলের যে প্রবল স্রোত সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল, তার জন্য পরিবেশ ধ্বংস, ও তার মূল অনুঘটক হিসেবে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে পর্যটন ব্যবসার বাড়বাড়ন্তকেই দায়ী করেছেন পরিবেশবিদরা৷ তাঁদের বক্তব্য, কেদারনাথ, বদ্রিনাথ বা উত্তরকাশীর মতো জায়গা যতদিন তীর্থস্থান হিসেবে ছিল, ততদিন বাড়তি জনসংখ্যা এবং তাঁদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থাগুলো পরিবেশের উপর চাপ ফেলেনি৷ কিন্তু যবে থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বাড়তে শুরু করল এবং তাঁদের জন্য পাকা রাস্তা থেকে শুরু করে বিলাসবহুল হোটেল তৈরি হতে শুরু করল, পরিবেশের তোয়াক্কা না করে এবং নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করে, তখন থেকেই বিপদের বীজ রোপিত হয়েছিল৷

এই পরিবেশ-যুক্তির বিরোধিতা অবশ্য এসেছে উত্তরাখণ্ডের মাটি থেকেই৷ স্থানীয় মানুষ এবং পরিবেশবিদদেরও এক বড় অংশের বক্তব্য, গাছ কাটা, পরিবেশ ধ্বংস ইত্যাদি নিয়ে ওই বক্তব্য একেবারেই ঠিক নয়৷ কারণ, ভারতে পরিবেশ আইন, বিশেষত হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে এখন অনেক বেশি কঠোর এবং একটা গাছ কাটলে তার বিনিময়ে ১০টা গাছ পুঁততে হয়৷ কাজেই গত ১০ বছরে উত্তরাখণ্ডে যত গাছ কাটতে হয়েছে জনপদ, রাস্তা বা অন্যান্য উন্নয়নের প্রয়োজনে, তার থেকে ঢের বেশি গাছ রোপণ করা হয়েছে৷ আর উত্তরাখণ্ডের মানুষের মৌলিক প্রশ্ন, তাঁদের কোনও উন্নয়নের অধিকার নেই, এটা কে ঠিক করে দিল? পর্যটন শিল্পের হাত ধরে তাঁদের রাজ্যে মানুষের যে পরিমাণ উপার্জন হচ্ছে এবং সেই সুবাদে তাঁদের জীবনযাত্রার মানের যে ক্রমোন্নতি হচ্ছে, সেটাকেই বা কেন গুরুত্বহীন করে দেখা হচ্ছে?

হিমালয় অঞ্চলের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে বিরাট ধস বা হঠাৎ মেঘ-ফাটা বৃষ্টির কারণে এই বিপত্তি ঘটে গেল উত্তরাখণ্ডে, তা কোনও অভূতপূর্ব ঘটনা নয়৷ এর আগেও এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে৷ তাই সাবধান হতে হবে মানুষকে৷ এবার যেমন নদীখাত দিয়ে নেমে আসা ঘোলাজলের স্রোত, নদীর ধারে গড়ে ওঠা জনবসত, এবং শৌখিন হোটেল আর রিজর্টকে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে বুঝিয়ে গেল, ভুলটা আমরাই করেছিলাম৷ তবে এটাও ঠিক যে এবার হিমালয়ের পরিবেশ পর্যটক এবং অভিযাত্রীদের জন্যে একটু বেশিই কঠোর এবং নির্মম ছিল৷ তবে তার কারণ সম্ভবত সারা পৃথিবীজুড়েই দূষণের কারণে বদলে যাওয়া পরিবেশ৷ এর জন্য খামোখা উত্তরাখণ্ডের পর্যটনকে দোষারোপ করা অর্থহীন৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য