পর্যটকদের চাপে সংকটাপন্ন ছেঁড়া দ্বীপ
বাংলাদেশের দক্ষিণের সবশেষ বিন্দু ছেঁড়া দ্বীপ৷ সেন্টমার্টিন থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণের এই দ্বীপে রয়েছে পাথর ও প্রবালের প্রাচুর্য। দ্বীপটি ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা না মানায় সংকটে পড়েছে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ৷
ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
সরকার ঘোষিত ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপে পর্যটকদের জন্য ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়৷ প্রতি বছর নভেম্বরে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২০ সালে ১২ অক্টোবর এ পরিপত্র জারি করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়৷
বিধিনিষেধ সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ
সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও ছেঁড়া দ্বীপে অবাধে যাতায়াত করছেন পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা৷ এতে সরকারি আইন যেমন লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তেমনি দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির জীব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে৷
গুচ্ছ দ্বীপ
সেন্টমার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনবিশিষ্ট কয়েকটি দ্বীপ বা দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে৷ নিঝুম দ্বীপ, প্রবাল দ্বীপ ও ছেঁড়া দ্বীপ মিলে এ দ্বীপপুঞ্জ গঠিত। তবে নামকরণের সুবিধার্থে এই তিনটি দ্বীপকে একত্রে ছেঁড়া দ্বীপ বলা হয়৷
পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপে গিয়ে দেখা যায়, দেখানে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়৷ সরকারি নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করেই প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক বিনা বাধায় ছেঁড়া দ্বীপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন৷
যত্রতত্র পড়ে আছে আবর্জনা
সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছেঁড়া দ্বীপে প্রবেশ করতেই দেখা যায় যত্রতত্র পড়ে আছে খাবার পানি ও কোমল পানীয়ের বোতল, চিপস ও সিগারেটের প্যাকেট, ডাবের খোসা ইত্যাদি৷ তবে এগুলো পরিষ্কার করতে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি৷
চলছে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন
সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপে সবধরণের যান চলাচল নিষেধ থাকলেও সরেজমিনে দেখা যায় সেখানে মোটরসাইকেল, ভ্যান, অটোরিক্সা, সাইকেল চলাচল করছে৷ সাইকেল ও মোটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় ঘন্টাপ্রতি এবং অটোরিক্সা ভাড়া নেওয়া যায় ট্রিপ হিসেবে৷
ভ্রুক্ষেপ নেই কারো
ছেঁড়া দ্বীপজুড়ে যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকলেও পর্যটকদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো সচেতনতা বা ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না৷ পর্যটকরা আসছেন, খাওয়া-দাওয়া করছেন এবং যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলছেন৷
ভেসে আসে ময়লা
ছেঁড়া দ্বীপের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে জোয়ারের সময় অর্ধেকটাই তলিয়ে যায়৷ বঙ্গোপসাগরে চলাচল করা বড় জাহাজ ও ট্রলারের ফেলে দেওয়া টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের বস্তা ইত্যাদি জোয়ারের পানিতে ভেসে দ্বীপের পরিবেশকে ঝুঁকিতে ফেলছে৷
পর্যটকেরা যাচ্ছেন নৌপথেও
সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকত থেকে স্পিড বোট, কান্ট্রি বোট, ট্রলারে করে অসংখ্য পর্যটককে ছেঁড়া দ্বীপে যাতায়াত করতে দেখা যায়। তবে সমুদ্রপথে ছেঁড়া দ্বীপে যাতায়াতের এ অভিযোগ অস্বীকার করেন কোস্টগার্ডের সেন্টমার্টিনের চিফ পেটি অফিসার মোঃ মোস্তাক আহমেদ।
গড়ে উঠেছে রিসোর্ট ও দোকান
সরকারি বিধি অনুযায়ী এ ধরণের সংরক্ষিত এলাকায় ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানায় জমি কেনা, এমনকি কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ আইনত নিষিদ্ধ৷ কিন্ত ছেঁড়া দ্বীপে ‘সিনবাদ’ ও ‘ইকো’ নামের দুইটি রিসোর্ট দেখা যায়৷ এছাড়া ছেঁড়া দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে একাধিক স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ দোকান গড়ে উঠতে দেখা গেছে৷
চার মাসের আয়ে সারাবছর
ছেঁড়া দ্বীপে অটোরিক্সা চালান মোঃ জিল্লুর রহমান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, এখানে যারা অটোরিক্সা চালান অথবা দোকানদারি করেন, তারা সবাই পেশায় মৎস্যজীবী। পর্যটকদের ভীড় শুরু হয় নভেম্বর থেকে, অর্থাৎ শীতের সময়ে। এই তিন-চার মাসের আয় দিয়েই তারা সারাবছর চলেন৷ তাই সেন্টমার্টিন-ছেঁড়া দ্বীপে পর্যটক আসা বন্ধ হলে তারা সমস্যায় পড়ে যান৷
নিষেধাজ্ঞা হটাতে ধর্মঘট
২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি ছেঁড়া দ্বীপে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা হটাতে তিন দিনের ধর্মঘট পালন করেন সেন্টমার্টিনের ব্যবসায়ীরা৷ ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে এ আন্দোলন করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা৷
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নেই উদ্যোগ
সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে অবস্থিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ ছেঁড়া দ্বীপে ময়লা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো কার্যকরী উদ্যোগ চোখে পড়েনি। পুরো দ্বীপজুড়ে যে দুই-তিনটি ডাস্টবিন চোখে পড়ে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে পর্যটকরা যেখানে সেখানে তাদের ব্যবহৃত পণ্য ফেলে সেখানকার পরিবেশ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ
ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপে ঘুরতে এসেছেন চাকুরিজীবী মিজান ফারাবি। তিনি বলেন, ‘‘ছেঁড়া দ্বীপে ভ্রমণ যে নিষেধ, এটা না জানাটা আমাদের ব্যর্থতা। প্রশাসনেরও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, কেন তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আর এখানে যে ময়লা আবর্জনা পরিবেশের ক্ষতি করছে, পর্যটক ঠেকাতে না পারলে এইগুলো হবেই। সরকার এবং পর্যটক, উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই ছেঁড়া দ্বীপকে রক্ষা করতে হবে।“
জোরালো পদক্ষেপ নেই
ছেঁড়া দ্বীপে ব্যবসা করেন এমন কয়েকজন জানান, এখানে সড়ক ও নৌপথে চলাচল নিষেধ থাকলেও যে যার ইচ্ছামতো চলাফেরা করছে। দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় পুলিশ পাহারায় আসলেও বাকি সময় অন্যরা সুবিধামতো কাজ চালিয়ে নেন। প্রশাসন সবই জানে, কিন্তু অনিয়ম বন্ধে তারা জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয় না৷