1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পরিবর্তনের বেদনা

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক রুমা মোদক৷
রুমা মোদক
১৯ আগস্ট ২০২৪

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া দুটি দেশের একটি পাকিস্তান। তার আবার দুটি অংশ ছিল- পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান।

https://p.dw.com/p/4jcXz
দেয়াল লিখন
পট পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি মাশুল দিয়েছে হিন্দুরাছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

হাজার মাইল দূরত্বে ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কহীন শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দেশ এবং রাষ্ট্র যে অকার্যকর তার প্রমাণ ছিল অনিবার্য ৭১।

ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদে ধর্মীয় পরিচয় গৌণ আর ব্যক্তিগত। ফলত ৭১-এর যুদ্ধ পরবর্তী অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ আদর্শিকভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে অগ্রাহ্য করেছিল সাংবিধানিকভাবে। আমরা ধর্মীয় বিভেদের উর্দ্ধে এক স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম,যার বিনিময় ছিল রক্ত, যে রক্তের ধর্মীয় পরিচয় ছিল না।

২০২৪-এ দাঁড়িয়ে সহস্র নিষ্পাপ প্রাণের বিনিময়ে আমরা আবার শুনছি- আমরা স্বাধীন হয়েছি। গণ অভ্যুত্থান নয়,গণ বিপ্লব নয়, ক্ষমতা বদল নয়, একনায়কতন্ত্রের পতন নয়- স্বাধীন। 

এই সময়ে ঠিক এই ‘স্বাধীন' ন্যারেটিভটি আমার কাছে  ছিল আশঙ্কার। অতঃপর স্বাধীন-পরবর্তী আমরা যে বাংলাদেশ দেখলাম, তা আশঙ্কার মতোই ভীতিকর,ভয়াবহ। সংখ্যালঘু ইস্যুতে এই ‘স্বাধীন' হওয়ার পরও আশার কিছু এখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি, শুধু প্রতিশ্রুতি ছাড়া। তবে ভবিষ্যতে আশার কিছু ঘটবে আশা করতে অবশ্য দোষ নেই৷

১৯৪৭ সালের পর পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া ৩০% হিন্দু ৭১-পরবর্তী সময়ে একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্নে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু ক্রমেই সে স্বপ্ন ধূসর হতে থাকে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া স্বাধীন দেশ আদর্শিক দিক থেকে ক্রমেই পশ্চাৎপসরণ করে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৌল কাঠামোর দিকেই হাঁটতে থাকে। সেই ইতিহাসের বয়ানও চর্বিত-চর্বন।  ৭৫-এর পট পরিবর্তনে তা কেবল ত্বরান্বিত হয়েছে আর ফলশ্রুতিতে বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার ৭%-এ নেমে এসেছে।

এদেশে বারবার সামরিক ক্যু হয়েছে, ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে আর বারবার দাবার গুটির মতো ব্যবহৃত হয়েছে এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যা-লঘিষ্ঠরা।

একটি স্বাধীন দেশ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। যে রক্তের হিন্দু-মুসলমান কোনো রং ছিল না সেই দেশে কবে থেকে হিন্দুরা ‘সংখ্যালঘু' হয়ে গেল? কেন হলো?

খেয়াল করবেন খ্রিষ্টান নয়,বৌদ্ধ নয়,কেবলই হিন্দু। এর পেছনের কারণ সম্ভবত ভূ-রাজনৈতিক।হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারত। ভারতের আধিপত্য এই দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল রাজনৈতিক এলিমেন্ট। ভারতের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের মতো সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেভেন সিস্টার্স কনসার্ন-সহ বাংলাদেশকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক স্বার্থ। ফলে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের আশঙ্কা জুজুর ভয়ের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় এ দেশের জনমানস কিংবা এই টার্মটি ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক গুটি হিসাবে। কিংবা প্রহসনের নির্বাচনে সরকার গঠন করা ব্যবস্থার দমবন্ধতা,বাকরুদ্ধতা, কিংবা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ক্ষমতাসীনদের শক্তির উৎস সন্ধানে। 

বাংলাদেশে মূলত সাংবিধানিকভাবে‘সংখ্যালঘু' শব্দটিঅস্বীকৃত হলেও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন বাদ-বাকিরা সংখ্যালঘুই হয়ে যায় বটে।

কিন্তু এই যে রামুর বৌদ্ধবিহার ছাড়া এ দেশে এ পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক হামলা,হয়রানি, লুটপাট, ধর্ষণ, জায়গা দখল সব হয়েছে হিন্দুদের, এর কারণ সম্ভবত এই ভারত-বিরোধিতা। বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও যখন হিন্দুদের উপর বারবার আক্রমণ আসে, তখন স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় এসব হামলা যতটা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক।

সাম্প্রতিক ‘স্বাধীনতা' অর্জনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হামলা করার পর, বেশ কিছু তালিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  আওয়ামী আমলে সংখ্যালঘু হামলার তালিকা।কেন বর্তমান নির্যাতনকে জাস্টিফাই করতে আওয়ামী লীগ আমলের তালিকা টানা হচ্ছে? যে পরিবর্তনের জন্য লড়াই, সেই লড়াইয়ে একটা নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ওপর হামলা, নির্যাতনকে জাস্টিফাই করা হচ্ছে সেই আমলের তালিকা দিয়ে! কোনো হিন্দু কোনো বক্তব্যে কোথাও কি সাফাই গেয়ে বলেছে, আওয়ামী শাসনামলে তারা শঙ্কামুক্ত, নিরাপদ এবং সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে এদেশে বাস করেছে? তবে কেন ‘মহান বিপ্লবীরা' অতীত দিয়ে বর্তমানকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে? এত রক্ত, এত আত্মদান ভালোর জন্যই না?

বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল কখনো হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়নি। যখন এদের পার্সেন্টেজ নির্বাচনে ভূমিকা রাখতো, তখন নির্বাচনে যে হারুক কিংবা যেই জিতুক আক্রমণের সহজ লক্ষ্য হতো হিন্দুরা৷ যেন এই হারা কিংবা জেতা পুরোটার নিয়ামকই হিন্দুদের ভোট।  নির্বাচন যখন প্রহসন হয়ে যায়নি, তখন এমন কোনো নির্বাচন হয়নি বাংলাদেশে যে নির্বাচনে নির্বাচনোত্তর হামলায় হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

হিন্দুদের অনিরাপত্তার বোধ এখান থেকেই সৃষ্ট। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দুরা উভয় পক্ষের আক্রমণের শিকার।যে দল হিন্দুদের ভোট-ব্যাংক ভেবে এসেছে এতোকাল,তারা হারলেও দোষ হিন্দুদের, হিন্দুরা নিশ্চয়ই ভোট দেয়নি। ধরো, মারো,কাটো হিন্দুদের। এদেরকেই আক্রমণ করা সবচেয়ে সহজ। আর আরেকদল, যারা নিশ্চিত হিন্দুরা তাদের ভোট দেয় না, তাদের তো খুব সহজ লক্ষ্য হিন্দুরা। এরকমই চলে আসছে এতকাল। প্রতিবাদ,প্রতিরোধহীন একতরফা সংখ্যালঘু আক্রমণ। এবং আতঙ্কিত হিন্দুদের নীরবে দেশত্যাগ৷ দেশত্যাগ মানে, সীমান্ত পেরোলেই ভারত- হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারত।

দিন বদলেছে। এখন আর নির্বাচন হয় না। হিন্দুদের ভোটও কমতে কমতে এমন হারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নির্বাচন হলেও তাদের ভোটে হারা, জেতা কিছুই আর নির্ভর করে না।

এখন কেন হিন্দু আক্রমণ? কারণ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য সংখ্যালঘু ইস্যুর চেয়ে সহজলভ্য আর কী আছে?

আর কী আশ্চর্য, একদল পতিত সরকারের সমর্থক হিসাবে হিন্দুদের আক্রমণ করছে, অন্যদল বলছে, পতিত সরকারি দলের গুন্ডাপান্ডারাই হিন্দুদের আক্রমণ করে বিশ্ববাসীকে দেখাচ্ছে।

আহা! এ যেন ‘শিল-পাটায় ঘষাঘষি,মরিচের দফারফা'।

আরেক দল দেখছি ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিকথনের ফাঁক-,ফোকড় দিয়ে দিব্যি বলছে, কিচ্ছু হয়নি সব গুজব। এই -গুজব তত্ত্ব' প্রমাণের জন্য সত্য মিথ্যা অসংখ্য প্রমাণও হাজির করছে।

এই যে কোটাবিরোধী আন্দোলন, কিংবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, কিংবা সরকার পতনের আন্দোলন শুরু থেকেই উচ্চকিত ছিল নানাবিধ গুজবে৷ পক্ষে বিপক্ষে,হত্যা,খুন,মৃত্যু,আহত,জ্বালাও-পোড়াও,থানা হামলা- কী নিয়ে গুজব ছড়ায়নি? অথচ যারা সরব তারা তো বটেই, কত নিরীহ মানুষের চেহারা চেনা গেল তখন। অন্য সব নিয়ে চুপ থাকা এই মানুষেরা হিন্দুদের ‘ধৃষ্টতা' সহ্য করলো না। হিন্দুরা আবার কথা বলে! কত বড় অপরাধ! গুজবের রাজ্যে নাটকগুলো বেশ সৃজনশীল ছিল। যেমন  হিন্দুরা নিজেরাই নিজেদের বাসা-বাড়ি আক্রমণ করছে আর দোষ দিচ্ছে অন্যদের।

‘‘বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতের মুসলমানদের চেয়ে ভালো আছে, এসবই এদের অযৌক্তিক দাবি''- এমন বক্তব্য আমরা হরহামেশাই শুনি। যেন সংখ্যাগরিষ্ঠদের অসীম দয়া। ভারতের মুসলমানদের মতো অবস্থা তাদের করেনি। নিজ দেশে পরবাসী হিন্দুরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠদের করুণায় বসবাস করে। এই যে দেশ ‘স্বাধীন' হওয়ার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বী সুহৃদরা বলছেন, ‘‘কোনো অসুবিধা হলে জানিও…কোনো অসুবিধা হলে চলে এসো…''- নিজের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটায় দাঁড়িয়ে ‘পরবাসী' হিন্দুদের এ যে কত বড় লজ্জা তার কোনো পরিমাপ হয় না।

এ দেশের হিন্দুরা কেন নিজ দেশে পরবাসী? গোড়া কেউ খুঁজতে যায় না, কিংবা জেনেও না জানার ভাণ করে, কিংবা অস্বীকার করে। এই অভ্যুত্থানে জাতির প্রাণ ৩২ নম্বর পুড়ে গেছে। সারা দেশের প্রায় সব ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বিটিভি, সেতু ভবন,মেট্রোরেলসহ বড় বড় স্থাপনায়। এখানে গুটিকয়েক হিন্দুর দোকান আর বাসা কোন ছাড়! কিন্তু গোড়ার প্রশ্ন এই, এ দেশের হিন্দুরা কেন বারবার আতঙ্কিত হয়? কেন পালায়? কেন দেশ ছাড়ে?

এই যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রায় সব কয়টি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি মাশুল দিয়েছে হিন্দুরা. ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি হলে মাশুল দিয়েছে হিন্দুরা, কোনো সরকার তাদের পাশে দাঁড়ায়নি তাদের অধিকারের কথা স্বীকার করে। সব রাজনৈতিক দল এবং সব সরকার হিন্দুদের রেখেছে তুরুপের তাস বানিয়ে। সময়মতো খেলে।

এই পুনঃপুন  নিরাপত্তাহীনতা, বারবার মনের জোর ভেঙে যাওয়া হিন্দুরা কোনো দিন কোনো সরকারের আমলে ফিরে পায় না। কেবল হারায়। তারা উদ্বাস্তু হয়। উন্মুল হয়। দেশান্তরী হয়। সকল সংকটে হিন্দুদের অসহায় অপেক্ষা করতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ এসে কখন নিরাপত্তা দেবে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা মনে করে, এই যে দয়া কিংবা করুণা দেখানো- এ বড় মহৎ কাজ। কিন্তু আদতে যে সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপট, অসভ্যতা আর বর্বরতার শামিল সেই উপলব্ধিই তাদের নেই। তার মতো অধিকার নিয়ে নিজের দেশে নিজের মাটিতে যার বাস করার কথা, তাকে দয়া দেখানোতে আদতে সে যে নিচে নেমে যায় সেটা বোঝার মতো প্রজ্ঞা এ জাতির নেই।

ব্যক্তিগতভাবে অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী আপনার বন্ধু,শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনার বিপদে এগিয়ে আসে। কিন্তু আপনার গ্রামের কোনো আত্মীয়, কিংবা অনাত্মীয় যখন শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে আক্রান্ত হয় তখন তা হয়, আমার বাবাকে জুতা দিয়ে মারতে মারতে বাজারের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় নিয়ে গেছে,আমাকে কিচ্ছু করতে পারেনি। মানীর মান ভগবানে রাখে'-র মতো। হয়তো ঢেউয়ের প্রাথমিক তরঙ্গ থেমে সব আবার শান্ত হবে৷

আদতে যুগের পর যুগ  সংখ্যালঘুরা জানবে কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনের বেদনা। এই মাটিতে খেলার শেষ নেই।

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক রুমা মোদক৷
রুমা মোদক শিক্ষক, লেখক।