পরিকল্পনার অভাবে অবহেলায় শিক্ষাখাত
১৭ জুন ২০২২এবার শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সামান্যই বেড়েছে, আর জিডিপির তুলনায় কমেছে৷ ২০২০-২১ অর্থ বছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিলো ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা৷ যা মোট বাজেটের ১১.৯২ শতাংশ৷ আর এবারের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২.০১ শতাংশ৷ এবার শিক্ষাখাত আলাদা করা হলেও আগের দুই অর্থ বছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে এক করে দেখানো হয়েছে৷ তাই এবারো শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত একসঙ্গে করলে এবার প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ কমেছে৷ এবারের বাজটে এই দুইটি খাত মিলিয়ে বরাদ্দ কমেছে শতকরা এক ভাগ৷ শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ আছে ৯৪ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা৷ প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৮৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা৷ যা চলতি বাজেটের চেয়ে সাত হাজার কোটি টাকা কম৷
আর জিডিপির হিসেবেও বরাদ্দ কমেছে৷ প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা জিডিপির ২.২৫ শতাংশ৷ আর চলতি অর্থ বছরের বাজেটে ২.৭৫ শতাংশ৷ এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা৷
এইসব তথ্য উপাত্তে এটা স্পষ্ট যে শিক্ষাখাতে যে কম বাজেট দেয়া হয় তার মধ্যেই হিসাবের ফাঁকি আছে৷ আগের দুই বছর শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত এক করে বরাদ্দ বেশি দেখিয়ে সেখান থেকে অর্থ নেয়া হয়েছে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে৷
ইউনেস্কো তথা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ থাকা উচিত৷ কিন্তু বাংলাদেশে তা কখনোই বাজেটের ১২ শতাংশ বা জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি হয়নি৷
বাজেটের শতাংশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭২ সালে৷ ওই বছর মোট ৭৮৬ কোটি টাকা বাজেটের মধ্যে ১৭৩ কোটি টাকা শিক্ষায় বরাদ্দ দেয়া হয়৷ যা ছিল মোট বাজটের ২২ শতাংশ৷ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘‘একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সময় ছাড়া আর কখনোই শিক্ষাখাততে গুরুত্ব দেয়া হয়নি৷ আন্তর্জাতিক মানের বরাদ্দ তো দূরের কথা আমরা আমাদের সমকক্ষ দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ দিচ্ছি৷’’ আর শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘এই বরাদ্দের মধ্যেও অনেক ফাঁকি আছে৷ যেসব খাতে বরাদ্দ প্রয়োজন সেখানে নাই৷ আর নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে সেটা ভাগ হচ্ছে নানাভাবে৷ কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষার উন্নয়নে এককভবে তা ব্যবহার করা যায় না৷’’
শিক্ষায় কেন এই অবহেলা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো উচিত৷ কিন্তু তার আগে দরকার বরাদ্দের অর্থ খরচ করার দক্ষতা অর্জন৷ তিনি বলেন, ‘‘আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন যা বরাদ্দ হয় তাও খরচ করতে পারে না৷ আর বরাদ্দের একটি অংশ দুর্নীতি খেয়ে ফেলে৷’’
তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো বাংলাদেশে শিক্ষা খাত নিয়ে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ ও যোগ্য লোক গড়ে তোলা যায়নি৷ ফলে শিক্ষার মাধ্যমে মানব সম্পদ উন্নয়ন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঠিক পরিকল্পনা নেই৷
তিনি বলেন, ‘‘এখনো আমরা এমএ-বিএ পাস করানোর পরিকল্পনায় আছি৷ দেশের জন্য প্রয়োজনীয় জনশক্তি তৈরির শিক্ষা পরিকল্পনা আমাদের নেই৷ যার ফলে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ে না৷ আর যারা বাড়তি বাজেট চান তারা পরিকল্পনা দিতে পারেন না৷’’
তার কথা, ‘‘সঠিক পরিকল্পনা, সঠিক বাস্তবায়ন এবং যোগ্য লোক দরকার শিক্ষার উন্নতির জন্য৷ তাহলে বাজেট বাড়িয়ে কাজ হবে৷ তা না হলে বাজেট বাড়ালেও তা খরচ হবে না৷ আর যা খরচ হবে তার একটি অংশ দুর্নীতিবাজদের পকেটে যাবে৷’’
শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘‘একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই৷ কিন্তু আমাদের এখানে আমরা কী করতে চাই তাই তো জানি না৷ সৃজনশীল প্রশ্নভিত্তিক শিক্ষা চালু করা হলো তাতে কোনো ফল হল না৷ এখন আবার শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করা হচ্ছে৷ তার কি প্রস্তুতি আছে? করোনার সময় টেলিভিশন ও অনলাইনে শিক্ষা ঠিকমত দেয়া গেল না৷ ডিভাইস না থাকায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি৷ এই বাজেটে তাদের জন্য কোনো পরিকল্পনা নাই৷ মানব সম্পদই যে বড় সম্পদ এটা আমাদের বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি৷ আমরা যে বড় বড় প্রকল্প করব, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব, তা কারা করবেন? সেটা স্পষ্ট হলে শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হত৷’’
শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা ধার করা জ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়েই চলবো কী না সেটার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না নীতি নির্ধারকেরা৷ তাই তারা শিক্ষাখাতকে অবহেলা করছেন৷ আগামী বছর থেকে যে শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে তার জন্য প্রচুর দক্ষ শিক্ষক লাগবে৷ বাজেটে তার জন্য বরাদ্দ কোথায়? আর শিক্ষকদের বেতন কাঠামো উন্নত না করলে তো মেধাবীরা শিক্ষক হতে চাইবেন না৷’’
গন্তব্য কোথায়?
বাংলাদেশের সমান কাতারের কোনো দেশেই বাজেট অনুপাতে শিক্ষা খাতে এত কম বরাদ্দ দেয়া হয় না৷ জিডিপির শতকরা চার ভাগের বেশি বরাদ্দ ওইসব দেশে৷ অধ্যপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘‘আমাদের সম কাতারে থেকে কোরিয়া, সিঙ্গাপুর শিক্ষায় বিনিয়োগ করে কত উপরে উঠেছে৷ ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং-এ দেখা গেল ভারতের ৪৪ টি, পাকিস্তানের ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে৷ আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই বছরের পর বছর সেখানে জায়গা পাচ্ছে না৷ এটা দেখেই তো বোঝা যায় শিক্ষাকে অবহেলা করে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি৷’’
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থাও বেশ খারাপ৷ ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা ১১২তম৷ বাংলাদেশের উপরে রয়েছে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান৷ মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘বাজেটের একটি দর্শন আছে৷ এই বাজেটে যে দর্শন আমরা দেখতে পাচ্ছি তার মধ্যে শিক্ষার দর্শন স্পষ্ট নয়৷ ফলে আমাদের বাইরে থেকে ধার করা জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চলতে হবে বছরের পর বছর৷ এটা হলো জ্ঞানের পরাধীনতা৷ আর সেটা যদি হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না৷’’
তার কথা, ‘‘শিক্ষা একটি সার্বিক বিষয়৷ এরজন্য গবেষণা, যোগ্য শিক্ষক এবং অবকাঠামো দরকার হয়৷ বাজেটে তার কোনো পরিকল্পনার ছাপ নেই৷ যার ফল হলো আমরা অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছি৷’’
আর অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান মনে করেন, ‘‘এমনিতেই বরাদ্দ কম, তার ওপর পরিকল্পনাহীন বরাদ্দ আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বোঝায় পরিণত করছে৷ এক সময় হয়তো আমাদের কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদনসহ আরো অনেক সেবা খাতে লোক পাওয়া যাবে না৷’’