পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাল ঠিকঠাক, আজ ‘অসুস্থ’ এবং বাদ!
৫ সেপ্টেম্বর ২০২২চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সোমবার সকালে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে গেছেন শেখ হাসিনা৷ পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অসুস্থতার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সফরে যাননি৷ কিন্তু তারপরও অনেকে মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিতর্কিত মন্তব্যে দুই দেশের সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার বিষয়টি নেপথ্যে কাজ করে থাকতে পারে৷
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রুহুল আমিন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, " (প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাদ পড়ার)সঠিক কারণ তো আমাদের পক্ষে জানা কঠিন৷ তবে আমরা ধারণা করতে পারি, স্ট্র্যাটেজিক কারণে হয়ত তিনি বাদ পড়েছেন৷ এটার প্রয়োজন ছিল, দুরদর্শী চিন্তা থেকেই হয়ত প্রধানমন্ত্রী এটা করেছেন৷ তারপরও বলবো, কেন প্রধানমন্ত্রী তাকে রেখে গেছেন- সেটা প্রধানমন্ত্রীই জানেন৷ কিন্তু আমরা ধারণা করি, উনার সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্যে দুই দেশের সরকারই বিব্রতর অবস্থায় পড়েছে৷ উনি যা বলেছেন তা পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে একেবারেই পড়ে না৷ ফলে উনাকে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক বলেই আমি মনে করি৷”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিবার বিকেলেও সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি এই সফরে থাকছেন৷ সোমবার সকালে হঠাৎ করেই দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর সফরে নেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীর তালিকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রীও ছিলেন৷ তিনিও যাননি৷ সকাল থেকে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রবিবার রাতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার খবরটি পৌঁছানো হয়৷ তবে সকাল থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা তার দফতরের কেউ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ ডয়চে ভেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে থেকেযোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে৷
হঠাৎ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাদ পড়ায় প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা? জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একটুও প্রভাব পড়বে না৷ কারণ, এখানে বৈঠক করবেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ ফলে ছবি তোলা ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো কাজ নেই৷ আর ফাইলপত্রের কাজ করার জন্য কর্মকর্তার অভাব নেই৷ এছাড়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তো আছেনই৷ কেন উনাকে সফর থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটা তো বাইরে থেকে বলা মুশকিল৷ তবে আমরা ধারণা করতে পারি, সাম্প্রতিক সময়ে দেওয়া উনার মন্তব্যগুলো দুই দেশের জন্যই অস্বস্তিকর ছিল৷ সরকারের তরফ থেকে যেটা বলা হচ্ছে, অসুস্থতার কারণে তিনি এই সফরে যেতে পারেননি৷ আপাতত আমরা এটাই বিশ্বাস করি৷”
এই ধরনের ঘটনা কি আগে কখনও ঘটেছে? সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একেবারে যে ঘটেনি, তা নয়৷ দেশ স্বাধীনের পরপর আমি জেনেভায় ছিলাম৷ একবার বঙ্গবন্ধু জেনেভা সফর করেছিলেন৷ তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সঙ্গে ছিলেন না৷ কিছুদিন পর আবার যখন সফরে যান তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ তবে হ্যাঁ, গত ৩০-৪০ বছরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো দেশ সফরে গেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সব সময় তার সঙ্গেই ছিলেন৷ এবারই ব্যতিক্রম হলো৷ অন্য দেশগুলোতে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা খুব বেশি থাকেন না৷ আমরা যখন পররাষ্ট্র দফতরে দায়িত্ব পালন করেছি, তখন মন্ত্রীদের আমরা ১৯৬২ সালের জেনেভা কনভেনশনগুলো, কূটনৈতিক বিষয়ে আগেই বুঝিয়ে দিতাম৷ তাতে তাদের অনেক উপকারও হতো৷ এখন হয়ত মন্ত্রীদের এগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব দেখা দিয়েছে৷ ফলে তারা যা বলছেন, সেটা কূটনীতিক হচ্ছে না৷”
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও পররাষ্ট্র বিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম জমির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কেন ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী নেননি সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই বলতে পারবেন৷ আমাদের পক্ষে সেটা জানাও সম্ভব না৷ ফলে যেটা আমরা জানি না, তা নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো৷”
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার যে ঘটনাটি ঘটেছে এমনটি আর আগে দেখা যায়নি৷ সবগুলো সফরেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন৷ আর ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরে তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকেনই৷ এবার শেষ মুহুর্তে তার নাম বাদ যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে খুবই আলোচনা হচ্ছে৷ এখন কেন তাকে বাদ রাখা হলো, সেটা ধারণা করা ছাড়া সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না৷ আমরা অপেক্ষা করি, দেখি কী জানা যায়?’’
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইট সোমবার সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে৷ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং একান্ত বৈঠক করার কথা রয়েছে৷ ৮ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার৷