পরমাণু বিদ্যুতের যুগ শেষ হবার পর জার্মানি কী করবে?
২ সেপ্টেম্বর ২০১১জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রের মারাত্মক দুর্ঘটনার জের ধরে জার্মানি বৈপ্লবিক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ ভূমিকম্প, সুনামি ও পরমাণু দুর্ঘটনার রেশ এসে পড়ে সুদূর বার্লিনে৷ ফুকুশিমার ঘটনার আগে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির সময়কাল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ কিন্তু রাতারাতি সেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতে বাধ্য হয় জার্মান সরকার৷
জার্মানির বিদ্যুৎ পরিষেবার কাঠামো
জার্মানির পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির মালিক ৪টি বড় কোম্পানি৷ কয়েক মাস আগে সরকার যখন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির আয়ু বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন তারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল৷ কিন্তু রাতারাতি একেবারে বিপরীত সিদ্ধান্তের ফলে তাদের এখন মাথায় হাত৷ তার উপর দেশের মানুষও ফুকুশিমার ঘটনার পর পরমাণু বিদ্যুতের ঘোরতর বিরোধী হয়ে উঠেছে৷ ফলে জোর গলায় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করাও বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলির পক্ষে সহজ নয়৷ এই অবস্থায় তারা ঘর সামলাতে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে৷ পরমাণু বিদ্যুতের দিন শেষ হওয়ার পরেও যাতে কোম্পানি হিসেবে তারা মুনাফা করে যেতে পারে এবং শেয়ারহোল্ডারদের খুশি রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে৷ তবে সেই পরিকল্পনার রূপরেখা এখনো স্পষ্ট নয়৷ এতকাল বিশাল মুনাফা করে এসে ভবিষ্যতেও সেই একই মাত্রার সাফল্য ধরে রাখা সহজ নয়৷
মুনাফা বনাম বিকল্প পথ
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, জার্মানির বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলি তাদের শেয়ারহোল্ডারদের উচ্চ হারে ডিভিডেন্ড দিয়ে এসে আখেরে নিজেদেরই সর্বনাশ করেছে৷ এখন নতুন পরিস্থিতি দেখা দিলেও কোম্পানির পুনর্গঠন বা সংস্কারের কাজ মোটেই সহজ হচ্ছে না৷ প্রতিযোগিতার বাজারে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার চেয়েও বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছে মুনাফা করা বেশি জরুরি৷ এই অবস্থায় তারা পরমাণু বিদ্যুৎ বন্ধ করার কুফলের মারাত্মক এক চিত্র তুলে ধরছে৷ আরডাব্লুই সংস্থার প্রধান ইয়ুর্গেন গ্রোসমান বললেন, ‘‘আমাদের আরও বেশি করে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য প্রস্তুত হতে হবে৷ তখন বছরে দুই বা তিন দিন বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে৷''
বেসরকারি কোম্পানি এমন হুমকির কথা বললেও এত নাটকীয় পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন না বিশেষজ্ঞরা৷ তবে তারাও জানতে চান, পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে এই সব কোম্পানি কোন পথ বেছে নেবে৷ এপ্রসঙ্গে গ্রোসমান বললেন, ‘‘ধরে নিতে হবে, পরমাণু বিদ্যুতের সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প হবে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি৷ আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস না থাকায় কয়লার ব্যবহারই তখন বাড়াতে হবে৷''
কিন্তু জার্মান সরকার জলবায়ু সংরক্ষণের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে, সেই কাঠামোর মধ্যে আরও জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই৷ উল্টে সেই লক্ষ্যে কার্বন নির্গমনের বর্তমান মাত্রা ধাপে ধাপে আরও কমিয়ে আনতে হবে৷ সরকার সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জল বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে চায়, যাতে নতুন করে বাড়তি নির্গমনের সমস্যাই না দেখা দেয়৷ সরকারের এই নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বড় বড় কোম্পানিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে কোটি কোটি ইউরো বিনিয়োগ করছে৷ তার ফলও পাওয়া যাচ্ছে৷ যেমন ইতিমধ্যে আরডাব্লুই সংস্থার উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ১৭ শতাংশই নবায়নযোগ্য জ্বালানি৷ কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে যে ঘাটতি দেখা দেবে, তা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাত্রা যথেষ্ট হবে না৷ জ্বালানি কোম্পানিগুলির মতে, ঠিক এই কারণেই তড়িঘড়ি করে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত একেবারে অবাস্তব৷
অতীতের ভুল ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
পরমাণু বিদ্যুতের বিরোধী শিবির অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ৷ তাদের মতে, জ্বালানি কোম্পানিগুলি বিকল্প জ্বালানির বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু বিনিয়োগ করেছে বটে, কিন্তু তা মোটেই যথেষ্ট নয়৷ তাদের আন্তরিকতার অভাবের ফলেই আজ এই সংকট দেখা দিয়েছে৷ তাছাড়া সরকারের ভূমিকারও সমালোচনা করছেন তারা৷ তাদের যুক্তি, শুধু মাত্র বড় জ্বালানি কোম্পানিগুলি ও তাদের বিশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির উপর নির্ভর না করে সরকারের উচিত ছিল স্থানীয় পর্যায়ে বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন প্রকল্পে উৎসাহ দেওয়া৷ কারণ এখনো বড় আকারে বিকল্প জ্বালানির উৎপাদন সম্ভব না হলেও স্থানীয় চাহিদা মেটাতে অবশ্যই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা সম্ভব৷ এর একটা বাড়তি সুবিধাও রয়েছে৷ বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে বিদ্যুতের দীর্ঘ লাইন পাততে হয়৷ ছোট আকারে পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে সেই বিশাল পরিকাঠামোরও প্রয়োজন হয় না৷ ফলে অনেক অর্থেরও সাশ্রয় হতে পারে৷
পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন ধাপে ধাপে বন্ধ হয়ে যাবে৷ জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানিও একদিন শেষ হয়ে যাবে৷ তখন বিদ্যুতে বাজারে আরও বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে বলে পূর্ববাণী করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ সেক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণ যেমন কমে যাবে, পরিকাঠামোর সদ্ব্যবহার ও আরও প্রতিযোগিতার ফলে উপকৃত হবেন গ্রাহকরাও৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক