পণ্যের দাম নির্ধারণ: বাস্তবায়ন করবে কে?
১৭ মার্চ ২০২৪তিন দিন হলো ২৯ ধরনের কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর৷ কিন্তু তাদের নির্ধারিত দামে গত তিন দিনে কোথাও ওই পণ্য কিনতে পারেননি ক্রেতারা, এমন অভিযোগ রয়েছে৷ নির্ধারত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে৷
আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘‘অযৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে বিপণন অধিদপ্তর দেশের মানুষের সঙ্গে কৌতুক করছেন৷ ওই দামে পণ্য বিক্রি সম্ভব নয়৷''
২০১৮ সালের কৃষি বিপণন আইনে কৃষিপণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন উভয় দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের৷ এটা বাস্তবায়নে বাধা দূর করতে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে৷ কৃষি বিপণন বিধিমালা ২০২১-এ অধিদপ্তরকে জেলা, উপজেলা এবং বাজার ভিত্তিক সমন্বয় কমিটি গঠন করে পণ্যের দাম বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে৷
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দুজনেই বলেছেন, ‘‘আইনে ওইসব পণ্যের দাম নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের৷ তারা বাস্তবায়ন করবে আশা করছি৷’’
জবাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম বলেন, ‘‘আমরা বাস্তবায়নের জন্য অভিযান পরিচালনা করতে পারি না৷ এরজন্য সরকারের অনেক সংস্থা আছে৷ আমরা মামলা করতে পারি৷’’
গত বৃহস্পতিবার ২৯ ধরণের পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে৷ তাতে কোন পর্যায়ে কোন পণ্যের দাম কত হবে তা বলে দেয়া হয়েছে৷ যেমন ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৪৫ টাকা ৭৮ পয়সা৷ উৎপাদন পর্যায়ে দাম ১৫১ টাকা ৮১ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১৬২ টাকা ৬৯ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা৷
একইভাবে গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ ৫৮৭ টাকা ৫০ পয়সা৷ উৎপাদন পর্যায়ে দাম প্রতি কেজি ৬০৫ টাকা ১৩ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ৬৩১ টাকা ৬৯ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সার কথা বলা হয়েছে৷
ডিমের (এক পিস) উৎপাদন খরচ ৮ টাকা ৮১ পয়সা৷ উৎপাদন পর্যায়ে দাম ৯ টাকা ৫ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ৯ টাকা ৬১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১০ টাকা ৪৯ পয়সা৷ দেশি পেঁয়াজ উৎপাদন খরচ ৪৪ টাকা, উৎপাদক পর্যায়ে দাম ৪৪ টাকা ৩০ পয়সা, পাইকারি ৫৩ টাকা ২০ পয়সা, খুচরা ৬৫ টাক ৪০ পয়সা৷ এভাবে পণ্যগুলোর দাম কোন পর্যায়ে কত তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে৷
কিন্তু বাজারে ব্রয়লার মুরগি কেজি ২২০টাকা, গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ টাকা, প্রতি পিস ডিম ১২ টাকা, দেশি পেঁয়াজ কেজি ৮০-৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে৷ এই হিসেবে প্রতিটি পণ্যের দামই বেধে দেয়া দামের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ ভাগ বেশি৷
যৌক্তি দাম বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কী ব্যবস্থা নিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর তা জানতে কথা হয় জেলা পর্যায়ের কয়েকজন কৃষি বিপণন কর্মকর্তার সঙ্গে৷ তারা জানান, ‘‘আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে যৌক্তিক মূল্য তালিকা জানিয়ে দিয়েছি৷ মূল্য তালিকা টানিয়ে দিয়েছি৷ তাদের ওই দামে বিক্রি করতে বলেছি৷ জেলায় জেলায় বাজার মূল্য মনিটরিং সমন্বয় কমিটি আছে তারাও এটা দেখবেন৷ যদি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হয় সেটা জেলার ডিসি সাহেবরা করবেন৷’’
তাদের কথা, ‘‘বাজারে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে৷ আমরা এই দাম নির্ধারণ করে দিয়ে এখন সচেতনতা সৃষ্টি করছি৷ সবাইকে যৌক্তিক মূল্য জানাচ্ছি৷’’
তবে পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘‘তারা অফিসে বসে অযৌক্তিকভাবে দাম নির্ধারণ করেছেন৷ ব্রয়লার মুরগির এখন উৎপাদন খরচ কেজি ১৭৫ টাকা৷ তাহলে এটা খুচরা পর্যায়ে কীভাবে ১৭৫ টাকা বিক্রি হবে৷ ডিমের যা দাম নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচও তাই৷ ব্যবসা না হলে আমরা উৎপাদন কেন করব? এতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে৷ বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না৷ ওই দামে কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না৷ তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কৌতুক করছে৷’’
আর দেশ কৃষিপণ্য নেটওয়ার্কের এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘‘আসলে কৃষিপণ্য পঁচনশীল৷ এখানে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়৷ এছাড়া চাঁদাবাজদের উৎপাত আছে, অনেক মধ্যস্বত্বভোগী আছে৷ সেই কারণে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যায়৷ যদি কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, আলাদা পরিবহন ও চাঁদাবাজি বন্ধ হতো তাহলে দাম কম হতো৷ ওগুলো বন্ধ না করে, বিবেচনায় না নিয়ে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সেই দামে বাজারে পণ্য পাওয়া যাবে না৷’’
এর জবাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম বলেন, ‘‘আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দুই মাস কাজ করে দাম নির্ধারণ করেছি৷ প্রতিটি পর্যায়ে কথা বলেছি৷ ওয়ার্কশপ করেছি৷ ওনারা যা বলছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ আমরা সঠিক দামই নির্ধারণ করেছি৷’’
বাজারে ওই দামে পণ্য পাওয়া কেন যাচ্ছে না তার জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা মাত্র ঘোষণা করেছি৷ প্রভাব পড়তে সময় লাগবে৷ এটা আগে ছিল না৷ এখন সবাই তো জানলো যে, যৌক্তিক দাম কোনটি৷ এখন বাজার মনিটরিং-এর মাধ্যমে ঠিক হবে৷ এই দাম আগেই নির্ধারণ করার ম্যান্ডেট আমাদের ছিল৷ তবে নানা কারণে আমরা করতে পারিনি৷’’
বাস্তবায়ন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এটা সরকারের পুরো মেশিনারিজের ওপর নির্ভর করে৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মোবাইল কোর্ট, আমাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ আরো অনেক এজেন্সি আছে তাদের সবার দায়িত্ব৷’’
আইনি ক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এই দাম কেউ না মানলে এক বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে৷ আমরা অভিযোগ পেলে আদালতে মামলা করতে পারি৷ কিন্তু সরাসরি অভিযান পরিচালনা বা শাস্তি দিতে পারি না৷ আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করি না৷ এটা জেলা প্রশাসক, ভোক্তা অধিদপ্তরসহ আরো অনেক দপ্তর আছে যারা করে৷’’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারিক কাজ করি৷ ঢাকা শহরেই এক বছরে ৩০ হাজার অভিযোগ পড়েছে এবং অধিকাংশই নিস্পত্তি করেছি৷ এছাড়া ভোক্তা অধিকারের জন্য সচেতনতামূলক অনেক কাজ করি৷ বাজার মনিটরিং আমাদের কাজের ছোট একটি অংশ৷ সেটা আমরা করি৷ কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য আলাদা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আছে৷ আইনে এটা তাদের কাজ৷ মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য আমরা জেলা প্রশাসন, পুলিশ সবার সহযোগিতা পাচ্ছি৷ আমাদের ৫৫টি টিম সারাদেশে কাজ করছে৷ এখন ওনারা (কৃষি বিপণন) চাইলেও পাবেন বলে আশা করি৷’’
মনিটরিং জোরদার করলে কৃষিপণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার প্রভাব বাজারে পড়বে বলে মনে করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু৷
তিনি বলেন, ‘‘তাদের এই কাজটি আগেই করা দরকার ছিলো, দেরিতে হলেও করেছেন৷ এখন মনিটরিং করতে হবে৷ কৃষি বিভাগের লোকবল অনেক৷ উপজেলা পর্যন্ত তাদের অনেক লোকবল আছে৷’’
তার কথা, ‘‘আইনে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন উভয় দায়িত্বই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের৷ দণ্ড ও জরিমানার বিধানও আইনে আছে৷ প্রয়োজন তাদের সক্রিয় হওয়া৷’’
এদিকে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও সোমবার বাজার দর নিয়ে বৈঠক ডেকেছে বলে জানা গেছে৷